
একুশের চেতনা বুকে ভর করার পর থেকে
চোখে জল আনা অনেকগুলো
প্রভাতফেরি দেখেছি আমি।
দেখেছি - লক্ষ মানুষের নগ্ন পায়ের স্পর্শে
কিভাবে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায় রাজপথ,
অসংখ্য মানুষের নিষ্পাপ মুখ থেকে
কিভাবে ঝরে পড়ে জোছনার ফুল,
তাদের উদাস চাহনিতে দেখেছি
হারিয়ে ফেলা ভায়ের জন্য কি গভীর ভালবাসা!
দেখেছি - রাজার দল কিভাবে সিংহাসন ছেড়ে
শহীদ মিনারে এসে শ্রদ্ধায় নত হয়ে থাকে
একুশের প্রথম প্রহরে।
একুশের সেই স্নিগ্ধ সকালে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে
কবিরা চলে আসে শহীদদের জন্য
নতুন কবিতার ছন্দ নিয়ে।
সুউচ্চ অট্টালিকার সাহেব-বেগমদের সাথে রাস্তায়
নেমে আসে নোংরা বস্তির জীর্ণ মানুষেরা।
আসে শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, মালি, মাঝি আর কৃষক।
লম্বা চুলের বাউলদের পিছে পিছে চলে আসে
ক্ষুধার্ত পথশিশুর দল।
নেকাবে মুখ ঢাকা সাদা পরীদের সাথে
একাকার হয়ে যায় নিষিদ্ধ নগরীর
সুন্দরী রমণীরা।
তুচ্ছ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই
এক অদ্ভুত মানুষ হয়ে ওঠে
শিশির ভেজা সেই একুশের প্রভাতে।
নতুন এক সূর্যের আহবানে জেগে ওঠা
পাখিদের সাথে সেদিন মুখর হয়ে ওঠে
নদী, বন আর সবুজ ধানের মাঠ।
মায়ের আঁচল ছাপিয়ে কোটি কোটি ফুল
ছড়িয়ে পড়ে তার ছায়া ঢাকা
শীতল বসতবাড়িতে।
তারপর বাইশ তারিখ সকালে হঠাৎ রেডিওতে
বেজে ওঠে এক ভয়ংকর বাংলিশ কণ্ঠস্বর,
মায়ের খোঁপার থেকে মুছে যায় পলাশের রং,
আঁচলের ফুলগুলো ঘুণপোকা হয়ে
কুরে কুরে খেয়ে ফেলে ভাষার অস্তিত্ব।
আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখি -
এদেশের মাটি, জল আর বাতাসের
সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো
মায়ের সম্ভ্রমকে কিভাবে ঠেলে দেয়
অসহায় মৃত্যুর দিকে।
আর প্রভাতফেরির নিষ্পাপ মানুষগুলো
কেমন যেন নির্বাক হয়ে থাকে
নিষ্প্রাণ পাথরের মত।
রাজনীতি নিয়ে রাজাদের ব্যস্ততায় ম্লান হয়ে যায়
অভিমানী মায়ের বিদগ্ধ কান্নার সুর।
শহীদদের রক্তে ভেজা রাজপথে দাঁড়িয়ে
অসভ্য মানুষেরা অবিরাম গেয়ে যায়
মুগ্ধতা ছুঁয়ে যাওয়া এক সর্বনাশী
ঘুম পাড়ানী গান।
আমি চিৎকার করে বলে উঠি -
কেন বায়ান্ন'র মত আর একবার গর্জে ওঠে না
প্রভাতফেরির লক্ষ মানুষের ঢল?
কেন আমরা আর একবার রক্ত দিয়ে কিনে
নিতে পারি না মায়ের ভাষার শুদ্ধতা?
তারা কি ভুলে গেছে -
এভাবে মরণ এলেই তবে অমরতা আসে?
আমার এই বুকভাঙা আর্তনাদ আস্তে আস্তে
মিলিয়ে যায় বাতাসে -
বেড়ে যায় প্রভাতফেরির কষ্ট

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: