বিশ্ব শিক্ষক দিবস: ইতিহাস, তাৎপর্য ও একটি পর্যালোচনা

দৈনিক সমসাময়িক ডেস্ক।। | প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:২৪

দৈনিক সমসাময়িক ডেস্ক।।
প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:২৪

ছবি- প্রভাষক গাজী মোস্তাফিজুর রহমান

আজ ০৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক তথা আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস এটি শিক্ষকদের জন্য একটি শ্রেষ্ঠ সম্মান। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দিবসটি পালিত হয়। সমাজ সংস্কার ও শিক্ষার সকল স্তরে মানসম্মত শিক্ষন প্রদানে শিক্ষকদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করাই দিবসটির উদ্দেশ্য ও লক্ষা। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ইউনেস্কোর ততকালিন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডেরিক এম. মায়ারের ঘোষণার ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২৭ অক্টোবর, ২০২২ তারিখে সরকারিভাবে জাতীয় শিক্ষক দিবস পালিত হয়। কিন্তু, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মন্ত্রিপরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে ৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের সাথে সমন্বয় করে সারাদেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হবে।

"Valuing teacher voices: Towards a new social contract for education," তথা "শিক্ষকের কণ্ঠস্বর, শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে নিয়ে এবছর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপিত হচ্ছে।

একটি প্রবাদ আছে 'Education is the Backbone of a nation' তথা 'শিক্ষন জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ড ছাড়া যেমন কোন প্রাণী মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া একটি জাতি আলোর মুখ দেখতে পারে না। শিক্ষাই পারে একটি মানুষের মনুষ্যত্ব, বিবেক, নৈতিক গুণাবলির বিকাশ সাধন করে সুজনশীল মেধাকে বিকশিত করার মাধ্যমে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে চিন্তাশীল করে গড়ে তুলতে। শিক্ষা আমাদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে, সমাজের কুসংস্কার, অনৈতিক কার্যকলাপ, অপসংস্কৃতি, বিকৃত চিন্তাধারাগুলোকে দূর করে, কিন্তু সে শিক্ষার পরিধি হতে হয় মহাকাশের মতো অসীম। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, 'শিক্ষা হল

সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা আপনি বিশ্বকে পরিবর্তন করতে ব্যবহার করতে পারেন।

মূলত শিক্ষা একটি বিমূর্ত (abstract) প্রপঞ্চ। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী হয়। এটি একটি গহিন

ও গভীরতর (Dynamic) ধারণা। গুহাবাসী জীবন থেকে এ ধারণা মানুষের সহগ। কোনো বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাই হলো জ্ঞান। দার্শনিক প্লেটো জ্ঞানকে প্রমাণিত সত্য বিশ্বাস বলেছেন। সংস্কৃত শাস ধাতু থেকে শিক্ষা শব্দের উদ্ভব। এর অর্থ শাসন করা, শৃঙ্খলিত করা, নিয়ন্ত্রিত করা নির্দেশ দেওয়া। শিক্ষার সমর্থক হিসাবে বিদ্যা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃত 'বিদ' ধাতু থেকে এর উদ্ভব। যার অর্থ জানা বা জ্ঞান আহরণ করা। আবার ইংরেজি 'education' শব্দটি ল্যাটিন 'educare' থেকে জাত। এর অর্থ প্রতিপালন করা (to bring up) বা নিষ্কাশন করা বা নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া (to draw out or to led out)। আরবিতে শিক্ষা হলো ইলম। মূলত শিক্ষা হলো একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রয়াস। শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হলো শিক্ষার্থীর মধ্যকার অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা। আর এর পরিধি হলো শ্রেণিকক্ষ বা পড়ার টেবিল থেকে সমগ্র বিশ্বালয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক উপায়ে মানুষ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে

এবং এ শিক্ষা দ্বারাই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে পরিচালিত হয়।

ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রথম পাঁচটি আয়াতের মধ্যে চারটিই শিক্ষা সম্পর্কিত আয়াত। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে 'ইকরা' অর্থাৎ পড়। এরপর বলা হয়েছে পড়ুন আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না। বাইবেলে বলা হয়েছে, 'Read' মানে পড়। সেখানে উল্লেখ রয়েছে 'জ্ঞানবানের শিক্ষা জীবনের উৎস তা মৃত্যুর ফাঁদ হতে দূরে যাওয়ার পথ। যে সতর্ক, সে জ্ঞানপূর্বক কর্ম করে; কিন্তু হীনবুদ্ধি মূর্খতা বিস্তার করে। জ্ঞানীর সহচর হও তবে জ্ঞানী হবে। কিন্তু যে হীনদের বন্ধু সে ভস্মীভূত হবে (হিতোপদেশ: ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২০)। বেদে উল্লেখ করা হয়েছে, হে জ্ঞানাধিপতি ভগবান, তুমি প্রকাশ্যমান সত্যগুণের দ্বারা আমাকে উদ্ভাসিত করো, আমার মনের সঙ্গে মিলিত হও। হে জ্ঞানরূপ

ঐশ্বর্যের অধিপতি, আমার অন্তরে অবস্থান করে আমাকে মেধাসমৃদ্ধি প্রধানে আনন্দিত করো (অধর্বেদ, ১ম কাণ্ড, ১ম অনুবাক, ১ম সুক্ত)। বৌদ্ধধর্মে সাধন্য দ্বারা সিদ্ধি অর্জনের করে সিদ্ধাচার্য হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে 'জ্ঞানীরা স্বচালিত। নিন্দা বা সুখ্যাতিতে তারা বিচলিত নন। বিন্দু বিন্দু বারি পতনে যেমন জলপাত্র পূর্ণ হয়, সেরূপ জ্ঞানী ব্যক্তি অল্পে অল্পে পুণ্য সঞ্চয় করে পরিণামে পুণ্যময় হয়ে ওঠেন (বুদ্ধবাণী, শিক্ষকবুদ্ধ: ধর্মপদ্য। বস্তুত সব ধর্মেই বিদ্যাশিক্ষা, দীক্ষা বা জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় আদিম সমাজে শিক্ষা ছিল অনানুষ্ঠানিক এবং অনিয়ন্ত্রিত। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় শিক্ষা প্রথমবারের মতো জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় শিক্ষা ছিল মূলত রীতিনীতি ও বিধানাবলির অনুশীলন। প্রাচীন ভারতে শিক্ষাকে মনে করা হতো মুক্তি ও মোক্ষ লাভের উপায়। প্রাচীন গ্রিসে শিক্ষাকে দৈহিক শক্তির চেয়ে উৎকৃষ্ট মনে করা হতো। প্রাচীন রোমানরা শিক্ষাকে বাস্তব অভিজ্ঞতার ফল মনে করত। খ্রিষ্ট ধর্মের অভ্যুদয়ের সময় শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নৈতিক মানের উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সংস্কার আন্দোলনের সময় শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয় মানবতাবাদ। দার্শনিক রুশো শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনাকারী। সর্বশেষ জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করে, যার মধ্যে ০৪ নম্বর অভীষ্ট হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা।

আদিগুরু সক্রেটিস বাস্তব জীবনভিত্তিক শিক্ষার কথা বলেছেন। প্লেটো শিক্ষার মাধ্যমে আপন সত্তাকে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত

করতে চেয়েছিলেন। 'Republic' & 'Law' গ্রন্থে তিনি শিক্ষাকে এক ধরনের জন্মান্তরের ক্রিয়া বলেছেন। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তির

যা কিছু আছে তাকে যথাযথ নির্দেশনার মধ্যে আনাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, নাগরিকতার জন্য শিক্ষা (education for citizenship) এবং জাতির নেতৃত্বদানের জন্য শিক্ষা (education for leadership)। পাশ্চাতা দেশে রুশো শিক্ষার নবযুগ শুরু করেন। তার মতে, 'প্রকৃতিই মানুষের একমাত্র শিক্ষক হওয়ার যোগ্য'। পেস্তালাৎসি প্রথম সর্বজনীন ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার কথা বলেন। মাদাম মারিয়া মন্তেস্বার স্বয়ং শিক্ষার (Self Learning) কথা এবং উপযোগী প্রশিক্ষণের কথা বলেন। তিনি শিক্ষা দানের চেয়ে শিখনের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেন। 'On education' গ্রন্থে বাট্রান্ড রাসেল শিক্ষাকে আলঙ্কারিক (Omamental) করার চেয়ে প্রয়োজনীয় করার কথা বলেন।

বস্তুত শিক্ষার উদ্দেশ্য মহৎ, মঙ্গল এবং পরমতার প্রতিভাসে উজ্জ্বল। সার্থক শিক্ষা মানুষকে সাধনা-শুদ্ধ জীবন ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে তোলে। কিন্তু এটি অর্জনের লক্ষ্যে কঠোরতর সাধনা, অনুশীলন ও একাগ্রতা আবশ্যক। এ কারণেই এরিস্টটল বলেছেন, 'শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেতো হলেও এর ফল সুমিষ্ট।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অধ্যায় ১-এ শিক্ষার ৩০টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। এসডিজিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষার জন্য ১১টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষাকে একটি রাষ্ট্রের জনগণের দৃষ্টিপট (Vision) হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। ইউনেস্কো এ প্রসঙ্গে গুণগত শিক্ষার একটি বর্ণনামূলক ধারণা প্রদান করেছে Quality has become a dynamic concept that has constantly to adapt to a world societies are undergoing profound social and economic transformation. Encouragement for future oriented thinking and anticipation is gaining importance. Old nations of quality are no longer enough despite the different contexts there are many common elements in the pursuit of a quality education, which should equip all people, women and men, to be fully participating members of their communities and also citizens of the world, মূলত গুণগত শিক্ষার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে, মৌলিক শিক্ষার বিকাশ এবং মান্নোনয়ন', টেকসই উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে সব পর্যায়ে বিরাজমান শিক্ষা কার্যক্রমে নবদিগন্তের সূচনা করা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং উচ্চশিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ। বস্তুত Jacques Deler Commission-এর গুণগত শিক্ষার অন্যতম স্তন্ত হচ্ছে-

জানতে শেখা, করতে শেখা, মিলেমিশে বসবাস করতে শেখা এবং বিকশিত হওয়ার জন্য শেখা।

এই গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান বাক্তি হলেন শিক্ষক। শিক্ষকতাকে একটি মহৎ পেশা বা ব্রত হিসেবে গণ্য করা হয়।

একজন শিক্ষক তার হৃদয় উজাড় করে ছাত্রদের শিক্ষা দেন। জাতির কপাল থেকে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে একটি শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি একজন অভিনেতাও বটে তাকে তার ছাত্রদের চাহিদা অনুযায়ী মানানসই অভিনয় করতে হয়। একজন শিক্ষক প্রতিটি ছাত্রের ভেতরকার ঘুমন্ত লাভার উদগীরণ এবং সুপ্ত প্রতিভার প্রজ্জ্বলন ঘটান। শিক্ষার আলো পেয়ে শিক্ষার্থীরা আলোকিত করে তাদের নিজেদেরকে এবং পরিশেষে তাদের সমাজ, দেশ ও বিশ্বকে। এ কারণে ফ্লোয়েবল শিক্ষকদের শিশু বাগানের মালিরূপে আখ্যায়িত করেছেন। স্যার জন এডামস শিক্ষকদের জাতির স্থপতি বা নির্মাতা বা কারিগর (A maker of men) বলেছেন। পার্সিভেল বেন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর বন্ধু, পরিচালক ও বিজ্ঞ উপদেষ্টা বলেছেন। ক্রো রিচি ক্রো তার Teaching in secondary school' গ্রন্থে শিক্ষককে শিক্ষা কর্মের মূল উৎস বলেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষক হতে হলে সারা জীবন ছাত্র থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

মূলত জীবনের সর্বাঙ্গীণ চাহিদার অনুকূল পরিচর্যার দায়িত্ব নাস্ত থাকে শিক্ষকের ওপর। তাই মৌলিকতা সুশিক্ষকের একটি মূল্যবান সম্পদ। ইন্টারনেট, স্মার্টবোর্ড বা মাল্টিমিডিয়া যাই বলুন না কেন, শিক্ষক এখনো শ্রেণিকক্ষের মূলপ্রাণ। তার উদ্ভাবিত শিখন শেখানো কৌশল ও রীতিই এখনো শিক্ষার্থীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। তিনি শুধু পড়ান বা শেখান না শিক্ষার্থীর উদ্যম, স্পৃহা স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন। আসলে চিত্তের প্রসারতা ও গ্রহিষ্ণুতা একজন শিক্ষককে সামঞ্জস্য বিধানের দক্ষতা দান করে। অহং শূনাতা তার নম্রতাকে প্রদীপিত করে। অকপট সারল্য তাকে মধুরতা দান করে। বাচন শৈলীর সুভাষিতা তাকে অনায়াসে শিক্ষার্থী প্রিয় করে তোলে। ফলত সংক্রমণশীলতার সক্রিয় প্রতিভূ হলেন শিক্ষক। প্রত্যয়দৃঢ় মানসিকতা তাকে উত্তমতা দান করে। নিরলস নিষ্ঠা ও নিবেদন তার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি। মানব চরিত্রায়ন ও জীবনের জীবনায়ন শিক্ষকের মূল ব্রত। তাই তিনি শিল্পীজনোচিত রস-সংবেদনার অনুরাগী হবেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আনন্দ বিতরণ করবেন আনন্দের অংশীদার হবেন, কিন্তু উপলক্ষ্য হবেন না। রস পরিবেশনে তিনি তথ্যনিষ্ঠ ও বৈদগ্ধের পরিচয় দেবেন। তার শিক্ষক জীবনের মূলে থাকবে সহজ জীবন ও মহৎ ভাবনা। গুণের লালন, অবগুণের মোচন এবং শিক্ষার্থীকে সত্যের দুয়ারে উপনীত করাই শিক্ষক জীবনের মৌল উদ্দিষ্ট ও আদর্শ।

এমন নিবেদিতপ্রাণ মহান শিক্ষক ছিলেন সক্রেটিস। তার যোগ্য শিষ্য ছিলেন প্লেটো। গুরুর চিত্তপ্রদীপটিকে বড় শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও মমতার মোড়কে আপন বক্ষে তুলে নিয়েছিলেন প্লেটো। ৩৮৭ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তিনি 'একাডেমিক নামক বিশ্বের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। প্লেটোর সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন এরিস্টটল। দীর্ঘ বিশ বছর প্লেটোর ছাত্র ও সহকর্মী থেকে তিনি লাইসিয়াম' নামক পৃথিবীর দ্বিতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এরিস্টটলের প্রিয় ও ধীমান ছাত্র ছিলেন মহাবীর আলেকজান্ডার। সুশিক্ষক প্লেটোর শ্রেষ্ঠ ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। আর এরিস্টটলের দিগ্বিজয়ী ছাত্র ছিলেন মহাবীর আলেকজান্ডার। মূলত বিশ্বের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক ছিলেন সক্রেটিস। আর প্লেটো ও এরিস্টটল ছিলেন দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র।

উপমহাদেশে শিক্ষকদের সেরা শিক্ষক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যিনি নিজ উদ্যোগে এতদাঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রসারে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ব্যক্তিগতভাবে ঋণে জর্জরিত হয়েছিলেন। ছাত্র থাকাকালেই তিনি এ দেশীয় শিক্ষার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছিলেন। তাই শিক্ষক হয়ে তিনি পাঠক্রম এবং বিদ্যাপীঠের কার্যক্রমকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল, ছাত্রদের বেত মারা বন্ধ করা। তিনি এ অঞ্চলের প্রথম শিক্ষা-গবেষক। ভালো শিক্ষককে ধরে রাখার জন্য তাদের তিনি মাইনে বাড়িয়ে দেন। মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের তিনি মাইনে মওকুফ করে দেন। এখন যে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিপ্রথা তা তিনি চালু করেন। এটি যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সে কারণে মৃত্যুর ১৬ বছর আগে তিনি তার অর্জিত সম্পদ উইল করে যান। দুরের বাজার থেকে তিনি হেঁটে সভায় বাজার করতেন; কিন্তু পাঁচ টাকার বই কিনে দশ টাকায় মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই করতেন।

বর্ত মান সময়েও মুক্তবাজার অর্থনীতির এ চ্যালেঞ্জের মধ্যে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের শিক্ষকসমাজ তাদের কর্তৃ বা কাজে অবিচল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের দেশে শিক্ষকতাকে মর্যাদাবান পেশা হিসেবে দেখার মানসিকতা এখনো গড়ে ওঠেনি। একটি আলোকিত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের মাঝ থেকে বৈষম্য শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। এ বিষয়ে অমার একান্ত একটি মতামত শিক্ষকতা হবে প্রথম শ্রেণি মর্যাদার-তিনি যে স্তরেই পাঠদান করুক না কেন। এজন্য শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল দেওয়া প্রয়োজন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, 'আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে একটি সভ্য, শিক্ষিত জাতির জন্ম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেব।"

সর্বোপরি এটা বলা যেতে পারে যে শুধু পদ্ধতিগত পরিবর্তন বা উচ্চ পাসের হার শিক্ষার মান বাড়ায় না প্রয়োজন গুণগত পরিবতন। শিক্ষাকে মানসম্মত করতে হলে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননশীলতা সাথে যোগসাজশ করে বিশ্বজনীন শিক্ষাকাঠামো সাজাতে হবে। আর এ জন্য একটি স্থায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষকদের অধিকার, দক্ষতা, দায়িত্ব এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনসাধারনকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষো জাতিকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হব এবং সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত হবে পক্ষান্তরে আমরা যদি তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি, আজকের এই দিনে সকল সম্মানিত শিক্ষকগণকে আবারও শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

লেখক,
গাজী মোস্তাফিজুর রহমান। প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ। মণিরামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ, যশোর। মোবাইল: 01728345843, ইমেইল: gmr.2nd [email protected]




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: