
ফুলের মূল্য অলিয়ার রহমান
[gallery ids="1762"] দুই মাস আগে মাহিন আর লাবণ্যর বিয়ের ঠিক হয়েছিলো পারিবারিক ভাবেই। দু'জনের পাশাপাশি গ্রাম। আগে তাদের সামান্য চেনাজানা ছিলো, কিছুটা ভালোলাগাও ছিলো , কিন্তু সেটা কখনো ভালবাসায় রূপ নিতে পারেনি। আজকের লেখাটা তিন দশক আগের একটা গল্প। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিলো না, ছিলো না প্রেমের ক্ষেত্রে এমন উর্বর স্বাধীনতা। যেহেতু ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো, তাই পড়ন্ত বিকালে মেয়েটির বাড়ির পাশে স্কুলের মাঠে মাঝেমধ্যে দেখা করার একটা সুযোগ ওরা পেয়েছিলো পরিবারের অনুমতিক্রমে। মাহিন অনার্স শেষ করে গ্রামে ফিরেছে, লাবণ্যেরও Hsc পরীক্ষা শেষ - এমন সময় এদের বিয়ে ঠিক হয়। তারপর দেখা করার সুযোগে ওরা পেয়ে যায় ভালবাসার স্বাদ। বিকাল হলেই দু'জনে অস্থির হয়ে যায় দেখা করার জন্য, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে দেখা করা হয়ে ওঠেনা সবদিন। মাহিনের বাড়ীর পাশে একটা ফুলের নার্সারি ছিলো। লাবণ্যর সাথে দেখা করার সময় সে প্রতিবার কিছু গোলাপ সাথে করে নিয়ে যেতো, আর নিয়ে যেতো একটা চিরকুট। সেই ফুল আর চিরকুট ছিলো লাবণ্যের জীবনে সবচেয়ে দামী উপহার। মাহিনের সামনে লাবণ্য কোনদিন চিরকুট খুলে পড়তে পারতো না। বাসায় গিয়ে যখন ছোট্ট চিরকুটটি খুলে পড়তো, তখন তার চোখে জল এসে যেতো। মনে হতো - এই ছেলেটিকে ছাড়া সে পৃথিবীতে একদিনও বাঁচতে পারবে না। বিয়ের তখনো এক মাস বাকি। এমন সময় মাহিন ভীষন অসুস্থ হয়ে গেল। শহরে নেওয়া হলো চিকিৎসার জন্য, কিন্তু কোন লাভ হলো না। বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হলো দুই মাস, ছয় মাস করে দুই বছর। মাহিন তখন মৃত্যু পথযাত্রি। এমন সময় লাবণ্যের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেল। মাহিন অসুস্থ বিধায় সংবাদটা তার কান পর্যন্ত পৌছালো না। লাবণ্যের বিয়ের পরেই চিকিৎসায় সাড়া দিলো মাহিনের শরীর। আস্তে আস্তে সুস্থ হতে থাকে মাহিন, আর অপেক্ষা করতে থাকে লাবণ্যের সাথে দেখা করার। দুই মাস পর চলাফেরা করার মত সুস্থ হয়ে যায় সে কিন্তু শরীর তখনো দুূর্বল। একদিন লাবণ্যের সাথে দেখা করার জন্য প্রস্তুতি নেয় মাহিন , এমন সময় জানতে পারে - দুই মাস আগে লাবণ্যের বিয়ে হয়ে গেছে অন্য গ্রামে তারই বন্ধু আবিরের সাথে। হঠাৎ মাহিনের পৃথিবীটা আঁধারে ঢেকে গেল, মনে হলো - তার বেঁচে থাকার সকল প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। অজানা এক অভিমানে চোখ দুটো ভিজে উঠলো তার। লাবণ্যকে দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলো তার সমস্ত দেহমন। মনে হলো - লাবণ্যকে একবার দেখার বিনিময়ে সে হারাতে পারে তার সবটুকু পৃথিবী। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না মাহিন। অসুস্থ শরীরে একদিন খুব ভোরে আবিরের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে সে। সে জেনে গিয়েছিলো - লাবণ্য এখন বাপের বাড়ি ছেড়ে আবিরের বাড়িতেই অবস্থান করছে। নিজের বাড়ি ছেড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পর ভাঙা শরীরে আবিরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় মাহিন। আবিরের ছোট বোন সেঁজুতি মাহিনকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো - ভাবি দেখে যাও, তোমার সাথে কে দেখা করতে এসেছে!! কি অদ্ভুত ব্যাপার - তুমি বলতে না বলতেই মাহিন ভাই এসে হাজির। কিন্তু দেখনা - মাহিন ভাই কেমন শুকিয়ে গেছে!! সেঁজুতির কথার উত্তরে লাবণ্যের গলা ভেসে এলো মাহিনের কানে। সে বললো - তোমার মাহিন ভাই গোলাপ না নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা চলে এলো ? এতো নিষ্ঠুর সে হলো কি করে? মাহিন বললো - আমার শরীরটা খুব দূর্বল সেঁজুতি। ফুল আনার শক্তি আমার নেই। তোমার ভাবিকে বলো , তার সাথে একবার দেখা করেই আমি চলে যাব। আবার এলে আমি অবশ্যই ফুল নিয়ে আসবো তোমার ভাবির জন্য। লাবণ্য বললো - সেঁজুতি, তোমার মাহিন ভাইকে জানালার পাশে একবার আসতে বলো , তার সাথে আমার কথা আছে। আস্তে আস্তে জানালার পাশে এগিয়ে গেল মাহিন। জানালার ওপাশ থেকে লাবণ্য বললো - মাহিন, আমি জানতাম আজ তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু গোলাপ না নিয়ে এলে তোমার সাথে দেখা করার কোন উপায় নেই আমার। আমি কিছু কথা বলবো তোমাকে , খুব মন দিয়ে শুনবে। আজ দশদিন হলো আবির খুব অসুস্থ, ডাক্তাররা কোন রোগ খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষ তিনদিন আবিরের শরীর অনেক খারাপ করেছে, আর এই তিনদিন আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম কেউ একজন আমাকে বলছে - অপেক্ষা করো লাবণ্য, পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি তোমার জন্য দুটো গোলাপ নিয়ে আসবে, আর তাতেই সুস্থ হবে আবির। যদিও তোমার সাথে আমার সংসার হয়নি, কিন্তু তোমার চেয়ে প্রিয় মানুষ এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই আমার। তিনদিন ধরে আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। আজ রাতের স্বপ্নটা ছিলো আরও অদ্ভুত। আমি দেখলাম - তুমি কল্পনার রাজপুত্রের মত সেজে আমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে আসছো। বহু দুর থেকে তোমাকে দেখে আমি পাগলের মত তোমার দিকে দৌড়াতে শুরু করি, তখন সেই লোকটি আবার আমাকে বললো - সাবধান লাবণ্য, তুমি মাহিনের সাথে এখন দেখা করবে না। আগে তুমি তোমার স্বামীকে বাঁচাও। কারো মাধ্যমে ওর কাছথেকে গোলাপ দু'টি নাও, তারপর ঐ ফুল দু'টি নিয়ে তুমি আবিরের দুই চোখের উপর রেখে দাও। এতেই তোমার স্বামী চিরতরে সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি তুমি আগে দেখা করো তাহলে ঐ ফুল তার কার্যকারিতা হারাবে আর তুমি হারাবে তোমার স্বামীকে। আমি জানি মাহিন - তুমি আমাকে দেখতে চাও, আমিও দু'চোখ ভরে দেখতে চাই তোমাকে, কিন্তু নিয়তি সেই পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লিজ মাহিন, তুমি আগে আমার জন্য দু'টো গোলাপ নিয়ে এসো, আমি আবিরকে বাঁচিয়ে তুলি , তারপর আমি তোমার সাথে দেখা করবো। প্লিজ মাহিন, প্লিজ, এই উপকারটুকু আমাকে করো। বন্ধ জানালার ওপাশ থেকে লাবণ্যের কান্নার সুর ভেসে এলো মাহিনের কানে। লাবণ্যের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল মাহিন। প্রকৃতির হিসাবটা অনেক বেশি জটিল মনে হলো তার কাছে। সে তো লাবণ্যকে সুখি দেখতে চাই। তাছাড়া লাবণ্যকে এক পলক দেখার বিনিময়ে পৃথিবীর যে কোন কাজ সে করতে পারে, তাহলে দ্বিধা কিসের? মাহিন বললো- ঠিক আছে লাবণ্য, তুমি অপেক্ষা করো, আমি তোমার জন্য ফুল নিয়ে আসছি। আবার হাঁটা শুরু করলো মাহিন। দুর্বল শরীর, পা চলতে চায় না, তবুও মনের জোরে হেঁটে চলে মাহিন। সূর্য্যটা তখন মধ্য আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। লাবণ্যর বাড়ি থেকে অনেক দুরে চলে এসেছে মাহিন। হঠাৎ সামনে একটা অবাক করা গোলাপের বাগান চোখে পড়ে তার। হাজার হাজার গোলাপে মুখর হয়ে আছে চারপাশ।দেখে মনে হয় - আমাদের চেনা পৃথিবীর সাথে এই বাগানের কোন মিল নেই, এটা বুঝি অন্য গ্রহের কোন ফুলের বাগান। মনের আনন্দে ফুল তুলতে গেল মাহিন, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো - প্রতিটি গাছের গোড়ায় একটা বিষধর সাপ ফণা তুলে বসে আছে , ফুল তুলতে গেলেই তাকে আক্রমন করার জন্য ছুটে আসছে সাপটি। কিছুই বুঝতে পারেনা মাহিন, এখান থেকে ফুল নেবার কোন উপায় কি আছে? এমন সময় একজন বুড়ির সঙ্গে দেখা হয় তার। বুড়িটি তাকে বললো -বাছা, এটা সাধারণ কোন বাগান নয়, এখান থেকে ফুল নিতে গেলে তার মূল্য তোমাকে পরিশোধ করতে হবে। কি দিতে হবে বলুন, - বললো মাহিন। বুড়ি বললো - এখানকার গোলাপের বিনিময়ে তোমার চোখ দু'টো দিয়ে দিতে হবে। আকাশ ভেঙে পড়লো মাহিনের মাথায়। চোখ চলে গেলে সে লাবণ্যকে দেখবে কেমন করে? সে বিষয়টা বুঝিয়ে বললো বুড়িকে, কিন্তু কোন লাভ হলো না তাতে। বুড়ি বললো - দেখো বাছা, ফুল নেবার আর কোন বিকল্প ব্যাবস্থা এখানে নেই। আসলে ফুল তোলার সাথে সাথে গাছটা মারা যাবে। এখানে তোমার একটা চোখ দিয়ে একটা গোলাপ গাছ এবং অন্য চোখ দিয়ে একটা সাপ তৈরি হবে। এই কারনেই, এই বাগানের গোলাপ গাছের সংখ্যা যেমন কমে না, তেমনি বাড়েও না। এখন তুমিই বলো, তুমি কি করবে। নিয়তির উপর বড় অভিমান হলো মাহিনের। তার সবটুকু পৃথিবী জুড়ে আছে শুধু লাবণ্য। চোখ দিয়ে দিলে সে লাবণ্যকে এই জীবনে আর দেখতে পারবেনা কোনদিন, আর না দিলে লাবণ্য তার স্বামীকে হারাবে চিরদিনের জন্য। তাছাড়া লাবণ্যের অনুরোধটা রক্ষা করতে না পারলে ওর সামনে গিয়ে কোনদিন দাঁড়াতে পারবেনা মাহিন। হয়তো বিধাতা তাকে বাঁচিয়ে রে্খেছেন লাবণ্যের স্বামীকেই বাঁচাবার জন্য! এমন অনেক কথা চিন্তা করে অবশেষে বুড়ির কথায় রাজি হয়ে যায় মাহিন। বুড়ির কাছে গিয়ে সে বলে - বুড়িমা, আমি আপনার কথায় রাজি, শুধু আমাকে গোলাপ দু'টি লাবণ্যের বাড়িতে পৌছাবার সুযোগটুকু দিন। ফুল দিয়ে আমি আবার এখানে চলে আসবো। বুড়ি বললো - তোমার এই অনুরোধটা আমি রক্ষা করতে পারবো, তবে শর্ত হলো তোমার সাথে এখান থেকে একটা সাপ যাবে। তুমি ফুল দিয়ে সাপের সাথে এখানে ফিরে আসবে, এর কোন অন্যথা হলে সাপের দংশনে তুমি সহ ঐ বাড়ির সবাই প্রাণ হারাবে। ফুল নিয়ে লাবণ্যের বাড়িতে হাজির হয় মাহিন। সেঁজুতির হাতে ফুল দু'টি তুলে দেয় সে। সেঁজুতি ফুল পেয়ে এক দৌঁড়ে চলে যায় আবিরের ঘরে। মাহিন সেই সুযোগে লাবণ্যের বাড়ি ত্যাগ করে নেমে পড়ে রাস্তায়। তাকে বুড়িমার কাছে ফিরে যেতে হবে , দেরি হলে সবার যে বড় বিপদ!! মাহিনকে নিয়ে বুড়িমা বিশাল বড় একটা ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে, নানা রকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা সেই ঘর। ঘরটা বরফের মত ঠাণ্ডা। বুড়িটি তাকে নিয়ে একটা বেডের উপর শুইয়ে দিলো। তারপর চোখ বন্ধ করতেই উপর থেকে দু'টি ছুরি এসে ঢুকে যায় মাহিনের দু'চোখে, আর ঠিক সেই সময় প্রচন্ড যন্ত্রনায় ঘুম ভেঙ্গে যায় মাহিনের, দ্যাখে - লাবণ্য মাহিনের বুকের উপর একটা হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে এক আকাশ ভালবাসা বুকে নিয়ে।তারপর বহু বছর কেটে গেছে। আজ মাহিন আর লাবণ্যের বড় মেয়ে নওরিনের গায়ে হলুদ। ছেলের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের জিনিসের সাথে এক তোড়া টকটকে লাল গোলাপ পাঠিয়েছে নওরিনের জন্য। ফুল দেখে চোখে পানি এসে যায় মাহিনের। মনে মনে বলে - আহা, আমার মেয়েটা যেন ফুলের মূল্য বুঝতে পারে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: