
-----------তিন ফকিরের গল্প ------------ অলিয়ার রহমান।
গল্প জানো? জানি মানে- ওতেই আমি রাজা, ব্যর্থ হলে সবাই মিলে দিও আমায় সাজা। শুনতে হলে লক্ষী হয়ে বসো আমার পাশে, বলে যাবো গল্প আমি কাজের অবকাশে। তবে আছে শর্ত শোন - বলবে না কেউ কথা, সায় জানাতে মাঝে মাঝে নাড়তে হবে মাথা। কোনটা বলি, কোনটা বলি - ভাবছি শুধু তাই, মনের চোখে খুজতে থাকি সকল ঠিকানায়। হায়রে জ্বালা একটিও না গল্প পড়ে মনে, মন পাখিটা খাঁচা ছেড়ে উড়ছে বনে বনে। তোরাও যদি চুপটি করে শুনিস কথা মোর, এতো জানি গল্প -তবু দেখছি চোখে ঘোর। আচ্ছা মামা - তিন ফকিরের গল্প বল শুনি, দারুণ কথা, তাইতো বলি - ভাগ্নে আমার গুণী।
দুরের গাঁয়ে একটি কোণে তিনটি বুড়োর বাস, ভাগ্য তাদের জীবন নিয়ে করছে পরিহাস। ভিক্ষা করে জীবন চলে - এই ছাড়া নেই গতি, এদের মাঝে একটা আবার আছে চালাক অতি। সেজন বলে - এমনি করে ক'দিন যাবে আর? ভুলের পথে জীবনটাকে করছি মোরা পার। একটু যদি বুদ্ধি নিয়ে ভাবিস নিরালায়, এই জীবনে আমরা কত সুখের ছোঁয়া পাই! অপর দু'জন বলে তাকে - এমন কি সে পথ? দুঃখটাকে এক নিমেষেই করবো কপোকাত!
সেই কথাটাই বলছি বাবা - সবুর নাহি সয়! সাধে কি আর লোকে তোদের পাগলা বুড়ো কয়? আমার কথা শুনলে জানি হবে ভীষণ লাভ, নাস্তা খাব ডিম ভাজি আর গাছের কচি ডাব।
আসল কথা বলতে কি তোর আছে কোন মানা? মধুর এসব কথাগুলো কার না আছে জানা? চটাং করে আসল কথা বল- না শুনি ভাই, প্যাঁচ লাগানো কথার মাঝে কাজের কথা নাই।
আরে বাবা বলছি - তোদের সয় না দেরি আর! দুটো কথা শুনেই তোদের মেজাজ হলো ভার? ধনী হতে চাইলে তোরা আমার কথা শোন, দয়া মায়া ছেড়ে সবাই পাষাণ করো মন। গেরাম ছেড়ে সবাই চল ঢাকায় গিয়ে উঠি, বিনা লাভে আমরা হেথায় করছি ছুটাছুটি। ঢাকায় গেলে পয়সা কত ! কত খাবে ভাত! স্টেশনে ঘুমিয়ে সবাই কাটিয়ে দেব রাত। অল্প দিনেই ধনী হয়ে ফিরবো সবাই বাড়ি, তিন শেয়ারে মিলে না হয় কিনব মোটর গাড়ি।
অবাক হয়ে অন্য দু'জন বলে - কথা খাঁটি, হেথায় বসে কেন তবে জীবন করি মাটি? কাল সকালে ঢাকা যাব - তুই আমাদের গুরু, এমনি করে তিনটে বুড়োর যাত্রা হলো শুরু।
তিনটে ফকির মিললো এসে গুলিস্তানের মোড়ে, করুণ সুরে পথচারীর মনটা নিলো কেড়ে । আমরা চিরদুঃখী ভায়া - দয়া করুন সবে, এই পৃথিবী ছেড়ে সবার চলে যেতে হবে। একটা টাকা দিলে তাতে হয়না কোন ক্ষতি, আখেরাতে দানের দ্বারা মিলতে পারে গতি। নামাজ পড়ে দু'হাত তুলে করবো মোনাজাত, পূরণ হবে মনটা আশা, ভরবে খালি হাত। কানা, খোঁড়া, কালা - মোরা তিনটে গরিব প্রাণ, কোর্মা পোলাও পাইনা খেতে, পাই যে শুধু ঘ্রাণ।
তিনটি মানুষ বসে বসে ফন্দি আঁটে কত! এমনি নানা ছলাকলায় দিবস হলো গত। কথার ফাঁকে দিনের আলো হলো পগার পার, সারাদিনে নাওয়া - খাওয়া হয়নি কিছু তার। রাতের বেলা টাকা গুনে উঠলো মাথায় হাত, জমার টাকা মরুক গিয়ে - কেমনে খাবো ভাত? তিনটা থালা কুড়িয়ে দ্যাখে একুশ টাকা মোটে! ঢাকার বুকে একুশ টাকায় কোন কচুটা জোটে? সারাদিনের ক্ষুধা নিয়ে কেমনে আসে ঘুম? ঢাকার লোকে দেয়না টাকা, শুধু কথার ধুম। তোমার কথায় ঢাকায় এসে জীবন যদি যায়, মরার পরে বিচার দিনে নালির দেব তাই।
গুরু বলেন - তোরা দু'জন অতি বাজে লোক, ক্ষিধেয় বুঝি মানুষ মরে? যত বাজে শোক! বিপদ হলে বুদ্ধিমানে ঠান্ডা রাখে মাথা, নানারকম হিসাব করে কাজটা করে যথা। আমি অনেক হিসাব করে বুদ্ধি পেলাম এক, তোদের মনে ধরে কি না - হিসাব করে দ্যাখ। একুশ টাকায় তিনটে লোকের ভরবে নাহি পেট, উদর ভরে খাদ্য খাওয়ার কালকে হলো ডেট। একুশ টাকার চিড়ে কিনে ভিজিয়ে রাখি সবে, কাল সকালে যে কেউ একা সকল চিড়ে খাবে। রাতের বেলা স্বপন দেখে যে জন হবে সেরা, সে জন সকল চিড়ে খাবে, করবেনা কেউ জেরা।
এই কথাতে রাজি হয়ে ঘুমায় আপন মনে, গুরু ঘুমায় ওদের মাঝে - চিড়ে মাথার কোণে। অন্য দু'জন ঘুমায় যখন নাকে তুলে ডাক, গুরু তখন হেসে বলে -" নিয়ম চুলোয় যাক"। নিয়ম চেয়ে জীবন বড় - ওরা কি তা বোঝে? কাল সকালে বলবো কিছু - চিড়ে যদি খোঁজে। আস্তে করে প্লেট নিয়ে করলো চিড়ে শেষ, প্লেট দিয়ে সেটা আবার রাখলো ঢেকে বেশ। মনের সুখে গুরু এবার ঘুমায় সারারাত, অন্য দু'জন ভাবে - গুরুর ঘুমটা উঁচু জাত।
সকাল বেলার স্বপ্ন নিয়ে বেজায় ঠেলাঠেলি, গুরু বলেন - মরণ হলো, তোরা পাগল হলি? আস্তে করে বলতো শুনি, রেজাল্ট দেব আমি, স্বপ্ন শুনে বোঝা যাবে - কার মাথাটা দামী।
দবির বলে - মক্কা গেলাম, মজার কথা শোন, ব্যাপার দেখে ভাবছিল আমি বিশাল ধনী যেন। হজ্জ করেছি মনের মত - পূরণ হলো আশা, তুমিই বল - স্বপ্ন এটা নয় কি হেভি খাসা?
আমার কথা শোন এবার, স্বপ্ন কাকে বলে! এমন মধুর স্বপ্ন ছাড়া জীবন নাহি চলে। স্বপ্নে দেখি - হঠাৎ আমি গেলাম মদিনায়, কত মানুষ এসে আমার সালাম করে পায়। আমি হলাম ইমাম সাহেব, সবার গুরুজন, স্বপন দেখে মুগ্ধ আমি ,ভরছে আমার মন।
গুরু তখন কয় না কথা, বোবা মানুষ যেন, অন্য দু'জন বলে - তুমি চুপটি করে কেন? তোমার স্বপন কওতো শুনি, শুনি পরান ভরে, গুরু বলেন - আমার কথা বলবো কেমন করে? সেই কথাটা বলতে আমার ভয়ে কাঁপে মন, তোরা হলে মরেই যেতি - ভাবছি সারাক্ষণ।
শুয়ে আছি আপন মনে তোদের দুয়ের মাঝে, হঠাৎ দেখি - আসছে কে যে অগ্নিমূর্তি সাজে। হাতের মধ্যে মস্ত লাঠি, ইয়া বড় দেহ, এমন মানুষ এই জীবনে দেখেনি যে কেহ। আমি বলি - কে গো তুমি? এখানে কি চাই? বলে - আমি গ্যালিভার, কিছুই মনে নাই? কান ধরে বলে - ব্যাটা, ওঠ তাড়াতাড়ি, চিড়েগুলো শেষ কর, নেই ছাড়াছাড়ি। তা না হলে লাঠি দিয়ে তুলে দেব ছাল, চিড়ে রেখে ঘুম পড়া? বুঝবে কি ঝাল।
কথা শুনে তাড়াতাড়ি থালা নিয়ে হাতে, ভয়ে ভয়ে চিড়েগুলো খাই কোনমতে। থরথর কাঁপে দেহ, ঘুরে যায় মাথা, জান নিয়ে বেঁচে আছি - এই বড় কথা। চিড়ে খাওয়া শেষ হলে লাঠি উঁচু করে, বলে - ব্যাটা শুয়ে থাক চোখে ঘুম ভরে। সেই ঘুমে হলো ভোর - কাহিনীটা এই, এরচেয়ে ভয় আর পৃথিবীতে নেই।
অন্যরা বলে -" তুই চিড়ে খেলি একা? আমাদের ডাকলি না, তুই এতো বোকা? তিনজনে চিড়ে খেলে কি বা হতো শুনি? গ্যালিভার আসবে তা আমরা কি জানি? আমাদের ডাক দিলে তিনজনে মিলে, চিড়ে খেয়ে বাঁচতাম, সুখ হতো দিলে।
গুরু বলে - মিছে তোরা দোষ দিস মোরে, তোদের আমি ডাকবোনা, ভাবলি কি করে? ডানপাশে হাত দিয়ে দেখি - তুই মক্কা, বামপাশে হাত দিয়ে খাই বড় ধাক্কা। কোনকিছু না বলে তুই গেলি মদিনায়, একা হয়ে ভয়ে আমি করি শুধু হায় হায়।
এরপরও তোরা বুঝি দোষ দিবি আমারে? ভালবাসার দাম নেই, আফসোস, আহারে!

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: