
শহিদুজ্জামান মিলন।।
১৯৭১ এ মণিরামপুর উপজেলার শহীদ আকরাম হোসেন কে নৃশংসভাবে ভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন নির্দয় নির্মম হৃদয় বিদারক হত্যাকান্ড দ্বিতীয়টি নেই।
শহীদ আকরাম হোসেন মণিরামপুর উপজেলার শেখপাড়া খানপুর গ্রামে ১৯৪৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম শেখ আলতাফ হোসেন, মাতার নাম জাবেদা খাতুন।১৯৬৮ সালে মণিরামপুর পাইলট হাইস্কুল থেকে এস এস সি এবং পরবর্তীতে যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করেন।
১৯৭১ এ তিনি চুয়াডাঙ্গা দত্ত নগর কৃষি ফার্মে কর্মরত ছিলেন। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং চাকুরী ছেড়ে এলাকায় চলে আসেন।
ছয় বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন শহীদ আকরাম হোসেন।ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ। শহীদ আকরাম হোসেন বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রথম থেকে মণিরামপুর, ঝিকরগাছার বাঁকড়া , শার্শা, কলারোয়া এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতার সাক্ষর রাখেন।যে কারনে অল্পদিনে রাজাকারদের টার্গেট হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা আকরাম।এমনকি পাকিস্তান সরকার আকরামের মাথার দাম ১০ হাজার টাকা ঘোষণা করেন।এসময় আকরাম বাড়িতে থাকতেন না। মাঝে মাঝে গোপনে গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসতেন। ১৯৭১ এর ১৭ অক্টোবর আকরাম তার এক সহযোদ্ধা যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ইসমাইল হোসেন কে সাথে নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন।সে সময় নিজ গ্রামের পাশে পেয়ারা তলায় তাদের সাথে রাজাকার অহেদ আলীর দেখা হয় ।অহেদ আলী রাজাকার ক্যাম্পে সে খবর পৌঁছে দেয়। আকরামদের ইচ্ছা ছিল রাতটুকু মায়ের কাছে কাটিয়ে সকালেই বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু সে সাধ আর পূর্ণ হল না। সকাল না হতেই রাজাকার মেহের জল্লাদের নেতৃত্বে ৪০/৫০ জনের একটি রাজাকার দল তাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। আকরামের মা তখন ছেলের জন্য সকালের খাবার বেড়ে বসে আছে। তাঁরা খেতে বসবে এমন সময় মেহের বিছানা ধরে টেনে ঝুড়ে ফেলে দেয়। আকরামের মা রাজাকারদের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে তাদের দুমুঠো ভাত খাওয়ার সুযোগ চাইছিলেন।
পাষন্ডের দল তাদের টেনে হিছড়ে বাড়ি থেকে বের করে আনেন। ইসমাইলকে বাড়ির পাশেই গুলি করে তারপর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
অপরদিকে আকরামকে মণিরামপুর বাজারে রাজাকার ক্যাম্প গিরীন ঘোষের বাড়িতে নিয়ে আসে।সপ্তাহব্যাপি তার উপর নির্মম নির্যাতন চলতে থাকে। হালসা গ্রামের রওশন আলীর ভাষ্য মতে ২৫ অক্টোবর বিকালে রাজাকাররা আকরামকে ধরে জুড়ান পুর মোড়ে নিয়ে আসে। পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে আকরামকে দিয়ে বাঁশ কেটে আনায়।এরপর ক্রুশের মত করে বাঁশ পুঁতে বাঁধা হয় ।ঐ বাঁশে আকরামকে বাঁধে পাতন গ্রামের মেহের জল্লাদ ও মাঝিয়ালী গ্রামের জামাল উদ্দিন।ঐ দুই জল্লাদ আকরামের শরীরের মাংস কেটে কেটে কুকুর কে খেতে দেয়।যন্ত্রনায় কাতর আকরাম পানি খেতে চাইলে পাশের গর্ত থেকে পানি এনে দেয়া হয়,এসময় সে জিভ বের করলে তার জিভ কেটে কেটে ফেলা হয়।এরপর তাঁর শরীরের চামড়া ছিলে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেশমাতৃকার এই বীর সন্তানকে হত্যা করা হয়।এরপর রাজাকাররা ঘোষণা করেন লাশ বাঁশে বাঁধা থাকবে,কেউ নামাতে পারবে না। রাতে আকরামের মা জাবেদা খাতুন,বোন জহূরা খাতুন এলাকার শান্তি কমিটির প্রধানের অনুমতি নিয়ে লাশ নামিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেন।
স্বাধীনতার বহু বছর পর্যন্ত শহীদ আকরাম হোসেন ও ইসমাইল হোসেনের কবর দুটি অরক্ষিত অবস্থায় বাড়ির পাশে বাগানে পড়ে ছিল সাম্প্রতিক শহীদ আকরাম হোসেন এঁর কবরটি পাকাকরন করা হয়েছে ।এই শহীদের নামে নেই কোন উল্লেখযোগ্য স্থাপনা যার মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম তাঁদেরকে জানতে পারবে।যে স্থানটিতে শহীদ আকরাম হোসেন কে হত্যা করা হয় সেই স্থানটি আকরাম মোড় নামে পরিচিত । মণিরামপুর উপজেলার প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম লুৎফর রহমান শহীদ আকরাম হোসেন এঁর নামে মণিরামপুর থেকে রাজগঞ্জ সড়কের নামকরণ করা হলেও অযত্নে অবহেলায় মানুষ তা ভুলতে বসেছে।
শহিদুজ্জামান মিলন,
শিক্ষক, গবেষক।
রূপদিয়া শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়।
যশোর।
০১৭৪৭৫০০২৭২


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: