
সফিয়ার রহমান।।
মহব্বত গাজি এবং রুহুল গাজি আপন চাচাতো ভাই। বাড়ি কয়রা থানার সিংহের চর গ্রামে। দুই ভাই সমবয়সী বিধায় বন্ধুর মত। সারাদিন নানা কাজের শেষে রাতে একসাথে ঘুমায়। দু’জনে এক আতœা, এক প্রাণ। জমিতে লবণ পানি উঠে যাওয়ায় মাঠে ফসল, কৃষিকাজ তেমন আর হচ্ছে না। দক্ষিণের দিন মজুর খেটে খাওয়া মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ কৃষি কাজ পাওয়ার জন্য যশোর জেলার দিকে যাচ্ছে,কেউ কাঠ কাটতে সুন্দরবনের দিকে যাচ্ছে। নোনাপানির কারণে সুন্দরবন লাগোয়া এলাকা পুরুষ শূণ্য হয়ে আসছে। প্রাণ চঞ্চল গ্রামগুলো নির্জীব হয়ে পড়ছে। মহব্বত খেলাধূলাসহ সকল কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। আসলে সব বিষয়ে বোঝে ভাল। সেখান থেকে সকলে মহব্বতকে মাতব্বর হিসাবে মাণ্য করে। এইভাবে চলতে চলতে এক সময় প্রকৃত নাম মহব্বত বিলুপ্ত হয়ে মাতব্বর নামেই সবাই চেনে। মহব্বতের কাছে এখন কেউ তার নাম জানতে চাইলে সেও বলে মাতব্বর। মাতব্বরই একদিন রুহুলকে বলল, এইভাবে বসে থাকলি দিন যাবে নারে, চল রুহুল বাদায় গিয়ে গাছ কাঁটিগে। মাহাজনের সাথে কথা বলিছি,আমাগের দুই ভাইর নিতি রাজি হয়েছে। গাজি কালু আর বনবিবির নাম স্বরণ করে দুই ভাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। জীবনে প্রথম সুন্দরবন দেখে দুই ভাই মোহিত হল। সারাদিন মনের আনন্দে কাজ করে ,রাত হলে রান্না নিয়ে ব্যস্থ হয়ে পড়ে। গলা ছেড়ে গান ধরে। এ সুখ বেশি দিন সইল না। একদিন বনে গাছ কাটার সময় রুহুলকে বাঘে ধরে নিয়ে গেল। দুই দিন খোঁজাখুজির পর রুহুলের মাথা এবং পা পাওয়া গেল। তাই নিয়ে এসে বাড়িতে দাফন করা হল। মাতব্বর শোকে দুখে পাথর হয়ে গেল। ছয় মাস চলে গেল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে। অভাবের তাড়নায় একদিন দলের সাথে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হল। আসার সময় অন্যান্যের মত মাতব্বরের মা পনের বিশখান আটার রুটি এবং গুড় গামছার মাথায় পুটুলি করে বেঁধে দিয়েছে। দুইদিন হাঁটার পর যশোরের মনিরামপুর থানার মদনপুর গ্রামে এসে পোঁছালো। লতিফ সরদার এলাকার মধ্যে গেরস্থ মানুষ,অনেক জমি,অনেক কাজ। লতিফ সরদারের বৈঠক ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। সারাদিন কাজ শেষে রাতে শুয়ে পড়লে ভাই রুহুলের কথা খুব মনে পড়ে। অন্ধকারে গোপনে চোখের পানি মুছে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে। পর পর পাঁচ বছর হল মাতব্বর কাজের সময় কাজ করতে মদনপুর আসে। গ্রামের সবার সাথে তার জানাশুনা হয়ে গেছে। সবাইকে ভালবেসে ফেরেছে। সেই সাথে ভালবেসে ফেলেছে দক্ষিণপাড়ার মান্দার মোড়লের মেয়ে ফুলবানুকে।সন্ধ্যার পর মাতব্বর মান্দার মোড়লের কাছে গিয়ে বসে। তার হুক্কায় তামাক সেজে দেয়। মান্দার মোড়ল টুকটাক কবিরাজি করে। মাতব্বর গুরু মেনে কবিরাজি শিক্ষা নেয়। কবিরাজি শিক্ষা প্রধান উদ্দেশ্য না,আসল উদ্দেশ্য ফুলবানুকে এক নজর দেখা। দিনে দিনে ফুল বানুও মাতব্বরের প্রেমে মজেছে। এক কান দুই কান হতে হতে মাতব্বর ফুলবানুর প্রেমকাহিনী মান্দার মোড়লের কানে পৌঁছে গেল। মান্দার মোড়ল শুনা মাত্রই আগুন হয়ে গেল। দক্ষিণে ছাবাল এ মেনে নেওয়া যায় না। মান্দার মোড়ল গাছিদা হাতে করে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। মাতব্বরকে হাতের কাছে পেলে দুইভাগ করে ফেলবে। মাতব্বরও ভয় পেয়ে গেল। দক্ষিণ পাড়ার ত্রিসীমানায় আর পা দেয় না তবে ফুলবানুর সাথে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ চলে। মহাজনের কাজ শেষ হয়ে এল, মাতব্বর বাড়ি যাবে। কোন চিন্তা ভাবনা না করেই এক রাতে ফুলবানুকে নিয়ে মাতব্বর পালিয়ে সোজা দক্ষিণে গ্রামের বাড়ি চলে গেল। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। সুখেদুখে এক বছর পার হয়ে গেল। সংসারের চাকা আর ঘুরছে না। মাতব্বর কাজে আসতে সাহস পায় না। এদিকে মান্দার মোড়ল ও তার স্ত্রীর রাগের পারদ নামতে নামতে তলানিতে এসে পৌঁছে বরফে পরিনত হয়েছে। তারাও মনে মনে চাইছে ফুলবানু ও মাতব্বর তাদের বুকে ফিরে আসুক কিন্তু মুখে বলতে পারে না। অভাব সহ্য করতে না পেরে মাতব্বর নাড়ির সম্পর্ক ছেদ করল। একদিন ভোর রাতে ফুলবানুকে নিয়ে মৃত্যুকে পরোয়া না করে শ্বশুর বাড়ি চলে এল। দু’জনেই হাতে পায়ে পড়ে অনেক কাঁদল। মান্দার মোড়ল কিছুই বলল না বরং তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে মেনে নিল। বিকেল হতে না হতেই সারা গ্রাম ঢি ঢি পড়ে গেল। দলে দলে মহিলারা মান্দার মোড়লের বাড়ি ভিড় করছে। তারা যেন চিড়িয়াখানার আজব প্রাণি দেখছে। বুড়ো ডাক্তার খ্যাত সামছুল হক মোড়ল শেষ বিকেলে তার বৈঠকখানায় বসে রোগির অপেক্ষা করছিলেন। তার সামনে দিয়ে তার বাড়ির বৌ ঝিয়েরা একহাত ঘুমটা টেনে মান্দারের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বুড়ো ডাক্তার বললেন,দল বেঁধে তোমরা কোথায় চলিয়াছ? গুলবাহার নামক তার বাড়ির কাজের মেয়ে একগাল হেসে বলল,দাদা ফুল বানু বারুই গিল না। একন আবার ভাতার নিয়ে ফিরে আইয়েছে, আমরা দেখতি যাচ্ছি। যাবা ? বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল। বুড়ো ডাক্তারের অলস সময় কাটছে না। এক পা দুই পা করে মান্দারের বাড়ি গিয়ে হাজির হল। এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তি এবং বিচার সালিশের একমাত্র মাতব্বর। তাই সবাই ব্যস্থ হয়ে পড়ল বসতে দেওয়ার জন্য। একটা জলচৌকি এনে বসতে দিল। বুড়ো ডাক্তারের সামনে পিঁড়ের উপর মাতব্বর সালাম দিয়ে বসল। উপস্থিত সকলে ভয়ে ভয়ে আছে কারণ বুড়ো ডাক্তারের মুখে কিছুই আটকায় না। হুট হাট করে যাকে তাকে যাতা বলে বসে। হাজার হলেও নতুন জামাই তাকে আবার কি বলে বসে সেটাই আতঙ্ক। বুড়ো ডাক্তার তীর্ষকভাবে নিরিক্ষণ করে বললেন, বাবা তোমার নামটা যেন কী? জে-- আমার নাম মাতব্বর। বুড়ো ডাক্তার চৌকি থেকে উঠতে উঠতে বললেন,তুমি আমাদের গ্রামের বালও না। উপস্থিত বৌ ঝিয়েরা মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরল,শুধু গুলবাহার হেসে কুটি কুটি। ঐ রাতে মাতব্বরের ঘুম হল না,বার বার বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগল। যেখানে তার নাড়ি পোতা আছে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: