অলিয়ার রহমান এর সৌদি আরবের ছোট ছোট গল্প- প্রথম খন্ড প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:৫৫

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:৫৫

ছবি সমসাময়িক
  প্রথম দিনেই খুব গুরুগম্ভীর একটা বিষয় নিয়ে আমি লিখতে বসেছি। সৌদি আরবে আমার অনেক রকমের অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু এই অভিজ্ঞতাটা একটু অন্য রকম। বিষয়টা আপনাদের পছন্দ হবে কিনা - জানি না। তবে ঘটনাটা আমার হৃদয়ে প্রচন্ড রেখাপাত করেছিলো। সেই কারণেই এই ইস্যুটা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমি আমার মতো করে লিখি, আগামী শুক্রবার আপনাদের পছন্দের ইস্যু নিয়ে লিখবো ইনশাআল্লাহ। -------------------আল্লাহ পাককে দেখা। আপনারা হয়তো শিরোনাম দেখে ভাবছেন - এটা আবার কেমন কথা!! আল্লাহ পাককে কখনো দেখা যায় নাকি? বিষয়টা এতোটা জটিল করে ভাববার দরকার নেই। বিষয়টা খুবই সহজ। চোখ কান খোলা রাখলে আল্লাহ পাককে দেখা যায় - এই লেখার শেষে আপনারাও সেটা বিশ্বাস করবেন বলে আমি মনে করি। আজ থেকে একযুগ আগের কথা। আমি আমার মিসেসকে নিয়ে হজ্জ পালন করার জন্য তাবুক থেকে মক্কায় রওনা দিলাম। আমাদের বিশজনের একটা দল। দলে নয়জন পুরুষ আর তেরোজন মহিলা। প্রত্যেকটা পুরুষের সাথে হয় তার স্ত্রী, না-হয় মা আছেন। শুধু একজনের সাথে ভদ্রলোকের স্ত্রী ও দুই মেয়ে আছেন বলে সংখ্যাটা নয়-তেরোতে গিয়ে ঠেকেছে। আমাদের আমিরের (দলনেতা) নাম আবু মুহাম্মদ। আমার এই লেখা যারা পড়ছেন - তাদের মাঝে অনেকেই হয়তো হজ্জ পালন করেছেন। কিন্তু কেউ কি তার স্ত্রী অথবা বৃদ্ধ মাকে সাথে নিয়ে হজ্জে গিয়েছেন? আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি - হজ্জ পালন করা পৃথিবীর বুকে অন্যতম একটা কঠিন কাজ। আবার বাংলাদেশ থেকে হজ্জে যাওয়া আর সৌদির কোন জেলা থেকে হজ্জে যাওয়া এক রকম না। বাইরের দেশ থেকে চল্লিশ দিনের ভিসা নিয়ে হাজীগণ সৌদিতে যান। ওনারা অনেক কাজ ধীরে সুস্থে করতে পারেন। কিন্তু সৌদির অভ্যন্তরীণ হাজীরা সময় পান মাত্র পাঁচদিন। তাদের মূল সমস্যা হয়ে যায় বিদায়ী তাওয়াফ। ছোট্ট একটা গল্প বলে বিষয়টা পরিস্কার করে দিচ্ছি। হজ্জের শেষদিন অর্থাৎ শয়তানকে শেষ পাথর নিক্ষেপের দিন আমরা সকাল সাড়ে আটটায় মিনা থেকে জামারাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তায় প্রচন্ড ভিড়। দ্রুতলয়ে হাঁটার কোন সুযোগ নেই। পাথর মারা শেষ করতেই দুপুর হয়ে গেল। সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা বের হয়েছি। সাথে নিয়েছি চার বোতল পানি আর কিছু শুকনো খাবার । বেশি খাবার নিতে পারবোনা, কারণ এতো ভিড়ের মধ্যে সেগুলো সামাল দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা খুবই দুরূহ একটা ব্যাপার। প্রচন্ড রোদ, কাজেই শয়তানকে পাথর মারার আগেই সব পানি শেষ হয়ে গেল। বুকে তৃষ্ণা নিয়ে আমরা জামারাত থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হেঁটে যেতে হবে সবটুকু রাস্তা। বহুদূর হাঁটার পর কিছু দোকান পেলাম। কিন্তু সেখান থেকে পানি কেনা সবার পক্ষে সম্ভব না। শত-শত লোকের সাথে যুদ্ধ করে দোকান পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে পানি কিনতে সক্ষম হলাম। পানি খেয়ে আবার মক্কার পথে হাঁটা শুরু । ইতিমধ্যে আমার স্ত্রীর পা ফুলে গেছে - ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না। মক্কার কাছাকাছি পৌঁছাতে আছরের আজান হয়ে গেল। আছরের নামাজ পড়ে বিদায়ী তাওয়াফের প্রস্তুতি নিলাম। প্রথমে কা'বা শরীফের পাশ দিয়ে তাওয়াফ করার চেষ্টা করলাম। মোট সাতবার ঘুরতে হবে। প্রথমবারের অর্ধেকটা ঘুরতেই মাগরিবের নামাজ শুরু হলো। নামাজ শেষে তাওয়াফের প্রথম পাক শেষ করলাম। এরপর চলে গেলাম ছাদে। সেখানেও ভিড় আর ভিড়। এক একটা পাক শেষ করতে একঘন্টা সময় লাগছে। উপরে গিয়ে দুইটা পাক দিয়ে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ওনার পা চলছে না। পানি পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। ছাদের এক জায়গায় পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে , কিন্তু সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা সাধারণ কোন বিষয় না। কিছু লোক স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। তাদের সহায়তায় দুই বোতল পানি সংগ্রহ করলাম। আমি নিজেই ক্লান্ত, তবুও একটু পরপর আমি আমার স্ত্রীর দুই পা টিপে দিতে লাগলাম - যেন বাকি চারটা পাক সম্পন্ন করতে পারেন। সেই সকাল সাড়ে আটটায় হাঁটা শুরু হলেছিলো। কখন শেষ হবে জানি না। আমার স্ত্রী পা উঁচু করতে পারছেন না। কিন্তু থেমে যাবার উপায় নেই। এক অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে রাত আড়াইটার সময় তাওয়াফ ও সায়ী শেষ করে আমার স্ত্রী মেঝেতে ( সাফা মারওয়ার সর্বশেষ প্রান্তে) শুয়ে পড়লেন। আমি অনেকক্ষণ পা টিপে দিলাম। এখনো প্রায় একঘন্টা হাঁটতে হবে। আমাদের দলনেতা ফোন করছেন - গাড়ীতে ফেরার জন্য। আবার হাঁটা শুরু হলো। দশ মিনিট হাঁটি, একটু বিশ্রাম নিই। আমার স্ত্রী সমানে কাঁদছেন - আর হাঁটতে পারছেন না। আমি সাহস দিচ্ছি, পা টিপে দিচ্ছি - এভাবে চলতে চলতে রাত সাড়ে তিনটার সময় আমরা গাড়িতে এসে পৌঁছালাম। উনিশ ঘন্টার বিরামহীন হাঁটা, সাথে ক্ষুধা আর বুকফাটা তৃষ্ণা। এই অভিজ্ঞতা যার নেই - তাকে এই কষ্ট বলে কোনদিনই বুঝানো যাবে না। এখানে বলে রাখা ভালো - আমি একা গেলে পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে আমার অর্ধেক সময় লাগতো। আবার আব যারা বাইরের দেশ থেকে হজ্জ পালন করতে যান - তাদের শেষ দিনের এই কষ্ট সহ্য করতে হয় না। কারণ বিদেশি হাজীরা তৃতীয় দিন পাথর মেরে আবার মিনায় ফিরে যান এবং সুবিধাজনক সময়ে মক্কায় এসে অতি সহজে বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করতে পারেন। আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে দুরে সরে গেছি। কথা হচ্ছিল - আল্লাহ পাককে দেখতে পাওয়া প্রসঙ্গে। জিলহজ্জের নয় তারিখে হাজীরা মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে হাজির হন। আছর পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। সন্ধ্যার একটু আগে পায়ে হেঁটে যেতে হয় মুজদালিফায়। যেহেতু সমস্ত হাজীরা একসাথে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন - সেহেতু এই জার্নিটা খুবই কষ্টের। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ একসাথে হাঁটছেন - একটু কল্পনা করলেই বিষয়টা আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমি মনে করি। স্বাভাবিক অবস্থায় আরাফাতের ময়দান থেকে মুজদালিফায় যেতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে। কিন্তু হজ্জের সময়ের চিত্রটা আলাদা। আর সাথে যদি মেয়েদের একটা বহর থাকে, তাহলে সময়ের হিসাব করে আর লাভ নেই। আমরা ভীড় সামলে ধীরে ধীরে হেঁটে রাত বারোটার দিকে মুজদালিফায় এসে পৌঁছালাম। মুজদালিফায় সকাল পর্যন্ত থাকতে হবে। আমরা ফজরের পর দলবেঁধে আবার মিনার দিকে রওনা দিলাম , উদ্দেশ্য জামারাতে গিয়ে শয়তানকে পাথর মারা। পাথর মারা শেষ করতে সকাল এগারোটা বেজে গেল। দলের সবাই ভীষণ ক্লান্ত, বিশেষ করে মেয়েরা। হাজীদের সাথে কোন পুরাতন লোক না থাকলে হজ্জ পালন করা নিতান্তই অসম্ভব। কারণ লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে তিনি রাস্তা চিনে হজ্জের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন বলে মনে হয়না। যাহোক - আমরা পাথর মেরে অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে একসময় নীচে নেমে এলাম। এখন ঘন্টা দুই হাঁটলেই আমরা তাবুতে গিয়ে (মিনায়) বিশ্রাম নিতে পারবো। প্রচন্ড ধকল গেছে দুইদিন। জামারাত থেকে বের হবার সময় আমার একটু খটকা লাগলো। আমার মনে হলো - আমরা ভুল পথে রওনা দিয়েছি। আমি আমাদের আমিরকে(দলনেতা) থামালাম। বললাম - আবু মোহাম্মদ, আমাদের বোধ হয় ভুল হচ্ছে। কারণ - সাইনবোর্ডে Exit লেখা অন্যদিকে। তিনি আমার কথা গ্রহণ করলেন না। তিনি বললেন - "এই রাস্তা দিয়ে গেলে আমরা আবার মুজদালিফায় গিয়ে হাজির হবো। আমরা এখন যে রাস্তায় যাচ্ছি - সেটাই মিনায় যাবার রাস্তা।" আমার দলে আমি আর আমার স্ত্রী শুধু বাংলাদেশী। বাকি সবাই আরাবিয়ান। কাজেই আমি তর্কে গেলাম না। আমিরের পিছনে হাঁটতে লাগলাম এবং প্রায় পঞ্চাশ মিনিট হাঁটার পর আমরা পুনরায় জামারাতে (শয়তানকে পাথর মারার স্থান) এসে হাজির হলাম। আমির সাহেব আমাদের ভুল পথে নিয়ে এসেছেন। দলের মেয়েরা যখন আর হাঁটতে পারছেন না, তখন এতো বড় একটা ভুল মেনে নেয়া আমাদের জন্য সহজ ছিলো না। তবুও কেউ কিছু বলছেন না। সবাই হজ্জ পালন করছেন বলে কথা। এখানে ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেল করলে চলবেনা। এই অবস্থায় আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলাম। ইঠাৎ আমরা লক্ষ্য করলাম - আমাদের থেকে সামান্য দুরে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা বসে বসে কাঁদছেন। হজ্জের সময় মেয়েদের মুখ খোলা থাকে। চেহারা দেখে মনে হলো- ভদ্রমহিলা হয় বাংলাদেশী, নাহলে ইন্ডিয়ান। আমাদের আমির আমার আর আমার স্ত্রীকে ভদ্রমহিলার কাছে পাঠালেন। কথা বলে জানলাম - উনি বাংলাদেশী, বাড়ি গাজীপুর জেলায়। মুজদালিফা থেকে সকাল আটটার সময় এখানে এসে তিনি দলছুট হয়ে গেছেন। এখন বাজে দুপুর একটা। সেই সময়ে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন এতোটা সহজলভ্য ছিলো না। সেই কারণে মহিলার কাছে মোবাইল নেই। ভদ্রমহিলা স্বামীর সাথে হজ্জে এসেছেন। এই মূহুর্তে তিনি স্বামীসহ পুরো দলকে হারিয়ে ফেলেছেন। মহিলাটি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত। পানি আর শুকনো খাবার উনার স্বামী বহন করছিলেন বলে এই দীর্ঘ সময় তিনি পানি থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন। বলে রাখা ভালো - হজ্জের সময় একাধারে চার/পাঁচ ঘন্টা পানি না পেলে সেই কষ্ট সহ্য করা কোন সাধারণ বিষয় না। আমরা ভদ্রমহিলাকে শুকনো খাবার আর পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার কাছে ফোন ছিলো। আমি উনার কাছ থেকে উনাদের আমিরের নাম্বার নিয়ে তাঁকে ফোন করলাম। হজ্জের সময় স্বেচ্ছাসেবক পুলিশ থাকে। জামারাতে প্রত্যেকটা পিলারের নাম্বার থাকে। ভদ্রমহিলাকে সতের নাম্বার পিলারের পাশে বসিয়ে দিলাম। উনাদের আমিরকে পিলারের নাম্বার বলে দিলাম। তবুও মন মানলোনা। আমরা স্বেচ্ছাসেবক পুলিশ খুঁজে এনে বিষয়টা জানালাম। পুলিশের কাছে আমিরের মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিলাম, সাথে আমার নাম্বারটাও। কোন রকম গন্ডগোল হলে পুলিশ যেন আমায় ফোন করে। সেই সময় আমি বাংলা ও আরবি সমানতালে বলতে পারি। ভদ্রমহিলার একটা সন্তোষজনক সুরাহা করে আমরা পুনরায় মিনার দিকে রওনা দিলাম। সেই সময় আমাদের আমির আমাদেরকে থামতে বললেন। একটু তুলনামূলক ফাঁকা জায়গায় এসে আমরা দাঁড়ালাম। আমির সাহেব আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন - "আপনাদের মধ্যে আল্লাহ পাককে কে কে দেখেছেন?" আমরা তো কথা শুনে অবাক - আল্লাহ পাককে দেখবো কেমন করে? উনি বললেন - "চোখ কান একটু খোলা রাখলেই আল্লাহকে দেখা যায়। একটু আগেই আমরা আল্লাহ পাককে দেখেছি।" তারপর তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন - "আমি সৌদি, দীর্ঘদিন আমি হজ্জের সাথে জড়িত। জামারাত থেকে মিনায় ফিরে যাবার রাস্তা আমার কোনভাবেই ভুল হবার কথা নয়। আল্লাহ পাক অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে আমাদের পুনরায় এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। কেননা - আমাদের দলে একজন স্ব স্ত্রীক বাঙ্গালী আছেন। আল্লাহ পাক এই ভদ্রমহিলাকে এখান থেকে উদ্ধার করবেন। উনি একজন হাজী মানুষ। হজ্জের সময় যে সমস্ত স্থানে দোয়া কবুল হয় - জামারাত তার মধ্যে অন্যতম। এই মহিলা সেই সকাল থেকে আল্লাহ পাকের কাছে কান্নাকাটি করছেন। আল্লাহ পাক ওনার দোয়া কবুল করলেন। তারপর ওনাকে সাহায্য করার জন্য আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিলেন। এই হলো আল্লাহ পাক। পৃথিবীতে আল্লাহ পাককে এভাবেই খুঁজে নিতে হয়। " হজ্জে গেলে মানুষের মন এমনিতেই অনেক বেশি নরম হয়ে যায়। তার উপর আল্লাহ পাককে এতোটা কাছ থেকে দেখে আমরা সকলে খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। আমাদের সকলের চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে গেল। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি!!!


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: