লেখক অলিয়ার রহমান এর লেখা বাস্তব সম্মত গল্প- স্মৃতি কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২১ ১৪:২১

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২১ ১৪:২১

ছবি সমসাময়িক
  ১৯৯৭ সালে এক প্রকার লেখাপড়া মাঝপথে রেখেই আমি বিদেশে চলে যায়। ফলে ১৯৯৮ সাল থেকে আমি কোরবানি করা শুরু করি। তখন তিন ভাই মিলে ( সবাই প্রবাসী) বাড়িতে একটা গরু কিনে দিতাম। ২০০১ সালে আমাদের কোরবানি আলাদা হয়ে গেল। অর্থাৎ সবাই আলাদা আলাদা গরু কেনা শুরু করলাম। আমরা বিদেশে থাকতাম, কিন্তু কোরবানি হতো দেশে (আমরা বিদেশেও কোরবানি করতাম)। আমাদের বাড়ির পাশে একটা উঁচু জমি কোরবানির জন্য নির্ধারণ করা হলো। বিশ বছর যাবৎ ঐ জমিতেই আমরা কোরবানি করে আসছি । ২০১০ সাল থেকে আমাদের কোরবানির সংখ্যা বেড়ে গেল। ছোট ভাই ডাঃ মেহেদী কোরবানি করা শুরু করলো। সেজ ভাই গরু কিনলেন দুইটা। সেই বছর থেকে আমাদের বাড়িতে পাঁচটা গরু আর পাঁচটা ছাগল কোরবানি হয়ে আসছে। আমরা দেশে স্থায়ী হয়েছি তিন বছর হলো। ঈদের দিন সকালে আমরা সব ভায়েরা একসাথে বাড়ি যাই, ঈদের নামাজ পড়ি এবং কোরবানি করে মাংস বণ্টন করে তারপর যশোরে ফিরে আসি। ঈদের দিন ( দুই ঈদেই) আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিশেষ রান্নার আয়োজন করা হয়। বড় বড় দুই ডেক মাংস রান্না করা হয়। দুপুরে আমরা সব প্রতিবেশীদের সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করি, পান খাই, গল্প করি। মনে হতো - সত্যিই আজ ঈদ এসেছে আমাদের জীবনে। ঈদের দিন সকালে শত শত লোক জমা হতো আমাদের বাড়িতে। আমরা সকালে বাড়ি গিয়ে দেখতাম - আমাদের বাড়ির উঠান, বাড়ির সামনের রাস্তা সব পরিপূর্ণ হয়ে গেছে মানুষে। গরিব মানুষ - সবাই ঈদের সেলামি চায়। আমরা ব্যাংক থেকে নতুন টাকা নিয়ে যেতাম ওদের খুশি করার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো - আমরা প্রবাসে থাকলেও রোজার ঈদ সবসময় দেশে এসে করতাম। রোজার ঈদ আমরা প্রবাসে করছি - এমন কোন স্মৃতি আমার মনে পড়ছেনা। শুধু মনে পড়ছে সেই অসহায় মানুষগুলোর কথা - যারা ঈদের দিন সকালে আমাদের বাড়িতে এসে একগাল হাসি নিয়ে ফিরে যেতো তাদের বাড়িতে। করোনার কারণে চারটা ঈদ আমরা বাড়িতে যাইনি। আমার আব্বা- মা'র বুকটা হাহাকার করে উঠে। সন্তান বাড়ি ফেরার মতো আনন্দ বাবা মা'র জীবনে আর কিছু নেই। ঈদের দিন খুব ভোরে আমরা চার ভাই ( সাথে চার বউ আর তেরজন ছেলে মেয়ে) সাজুগুজু করে বাড়িতে গিয়ে আব্বা মা'কে সালাম করছি - এটা যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য। এতোগুলো প্রাণপ্রিয় মানুষকে একসাথে দেখে আমার মা আনন্দে কেঁদে ফেলতেন। সেই আনন্দঘন কাঁদার দিন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সুখের কান্না আজ আর নেই - আছে শুধু বেদনার কান্না। কোরবানির কথা বলছিলাম। এই যে আমি দীর্ঘ বাইশ /তেইশ বছর ধরে কোরবানি করছি - গরু কেনার যন্ত্রণা আমাকে সহ্য করতে হয়নি কোনদিন। আমার আব্বা মাশাল্লাহ এখনো শক্ত সার্মথ্য মানুষ। উনি আশেপাশের গ্রাম থেকে ঘুরে ঘুরে গরু ছাগলগুলো কিনতেন। করোনার মধ্যে গত বছরও আমরা গ্রামে কোরবানি করেছিলাম। আমরা কেউ যাইনি। আব্বা ছিলেন, আর কিছু লোক আমরা নিয়োগ দিয়েছিলাম কাজটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। শুধু আমাদের ড্রাইভাররা গিয়ে আমাদের জন্য সামান্য কোরবানির মাংস নিয়ে এসেছিলো। এবারও সেই রকম প্ল্যান ছিলো। কিন্তু আব্বা আপত্তি করলেন। ওনার শরীর খারাপ। এতো ধকল উনি নিতে পারবেন না। বাড়ির আশেপাশের অনেকের করোনা পজেটিভ। আমাদের যাবার কোন সুযোগ নেই। অগত্যা কোরবানি করতে হলো যশোরে। দীর্ঘ তেইশ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে পড়লো। ঈদের আগের দিন সারারাত ঘুমাতে পরলাম না। বারবার মনে পড়ছিলো - গরিব মানুষগুলো আমাদের বাড়িতে এসে খালি হাতে ফেরত যাবে। দীর্ঘ তেইশ বছর তাদের আশার জায়গা ছিলো আমাদের বাড়ি। কি হবে তাদের? করোনা আমাদের সমস্ত সমাজ ব্যাবস্থা ভেঙ্গে দিয়েছে, ভেঙ্গে দিয়েছে আমাদের পুরাতন ঐতিহ্য। আমি কোরবানির কথা বলার জন্য এই লেখা শুরু করেছিলাম। মাঝে অনেক স্মৃতিকথা লিখে ফেললাম। যাইহোক, যেহেতু যশোরে কোরবানি করবো - সেহেতু গরু কিনতে হবে এবার। করোনার কথা চিন্তা করে বাজার থেকে গরু কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করলাম। শহরের পাশের গ্রাম থেকে গরু কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিন ভোর বেলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গরু কিনতে বেরিয়ে পড়লাম। গরু একটা পছন্দ করে বায়না করে এলাম। একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা গরুটা লালনপালন করেছেন। তার বাড়ির গরু। গরুটার মাকে আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন অভাবের তাড়নায়। তার মা'কে বিক্রি করার ইতিহাস শুনলাম। মহিলার বড় মেয়ের বিয়ে। হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। বাছুরটা তখন ছোট, ওটা বিক্রি করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে না। অগত্যা তার মা'কে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। বাজারে নেবার আগে ভালো করে গোসল করানো হলো গরুটাকে। গরুটা বুঝে গেল - তাকে বিক্রি করে দেওয়া হবে। গরুটা কান্না শুরু করলো - সাথে বাছুরটাও। খেতে দেওয়া হলো, গরুটা কিছুই খেলোনা। সারাক্ষণ সে জিহ্বা দিয়ে তার বাছুরটাকে আদর করতে লাগলো। মহিলা সহ্য করতে পারলেন না। উনি গরুটার কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন -" তুই যা মা, তোর বাচ্চাটাকে আমি তোর মতো করেই বুকের মাঝে আগলে রাখবো। আমিও মা, তোর কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু কি করবো বল - আমি যে অসহায়।" গরুটা কি বুঝলো জানি না, সে জিহ্বা দিয়ে মহিলাকে একবার আদর করে তার সন্তানকে রেখে ভেজা চোখে রওনা দিলো বাজারের দিকে। সকাল আটটায় মহিলার বড়ছেলে পাঁচ/ছয়জন কসাই সাথে করে গরু নিয়ে এলো আমার গাড়ির শো-রুমে। আমি গিয়ে দেখি - গরু কাঁদছে। আমার মনটায় খারাপ হয়ে গেল। আমি মহিলার ছেলেকে গরুর কান্নার কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো- "স্যার, আপনি বায়না করে আসার পর থেকে গরুটা কাঁদছে। আজকে গরু আনার সময় মা অনেক কেঁদেছে। মাও কাঁদছে, গরুও কাঁদছে - কি যে জ্বালা স্যার!! মা গরুটার গলা জড়ায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো - "আমাকে মাফ করে দাও বাপ। পশু হয়ে তোমাদের যেমন অসহায়ত্ব আছে - মানুষ হয়ে আমাদেরও আছে মনুষ্যত্বের যন্ত্রণা। জানিনা - আমাদের এই কষ্ট তোমরা বুঝতে পারো কিনা।" গরু কোরবানি হয়ে গেল। আমি দুপুরের পরে ড্রাইভারকে দিয়ে ভদ্রমহিলার বাড়িতে মাংস পাঠিয়ে দিলাম। ভদ্রমহিলা মাংস নিলেন না। তিনি আমার ড্রাইভারকে বললেন -" এই গোশত আমি নিতে পারবোনা বাবা। তুমি গোশত ফেরত নিয়ে যাও। নিজের সন্তানের গোশত কি কেউ খেতে পারে বলো?" আমার চোখ দুটো আর একবার ভিজে উঠলো।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: