সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখা ছোট গল্প- ভানু দিদি'র করোনা কাল

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৫ জুলাই ২০২১ ১৬:৪৮

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৫ জুলাই ২০২১ ১৬:৪৮

ছবি সমসাময়িক

     ভানু দিদি'র করোনা কাল          মোঃ শাহ্ জালাল।।

  ইদানিং আর মানুষের মুখে মাস্ক ব্যবহার করায় হাসি দেখাই যায় না। তার উপর আবার করোনাভাইরাসের মহামারিও কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের মুখের হাসি। চারিদিকে শুধু কান্না আর কান্না। মনিরামপুর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের ঘোষ পাড়ার বাসিন্দা নিমাই ঘোষ। ব্যক্তিগত জীবনে নিমাই ঘোষ সরকারি চাকুরিজীবী হিসাবে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারি ছিলেন। গতদুই বছর হলো চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। অভাব অনাটনের সংসার ছেলে-মেয়ে'রা সবাই যার যার মতো আলাদা হয়ে গেছে। সর্বশেষ পেনশনের টাকায় বাকি ছোট মেয়েটা'কে বিয়ে দিয়ে হাত খালি, হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। কোন উপয়ান্ত না পেয়ে জীবীকার তাগিদে নিমাই এখন চা বিক্রেতা। বাড়ির পিছনে পাকা রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা ঘর সেখানে নিমাই ও তার স্ত্রী ভানু দিদি চা বিক্রি করে। দুজনের সংসার যা আয় হয় তাতে কোনমতে চলে সংসার টেনেটুনে। নিমাই ও ভানু দিদি'র চা-এর দোকানে বসে একদিন কিছু অলস লোক আড্ডায় মেতেছে। তারা এক জন অন্য জনকে গুল মারে (অর্থাৎ মিথ্যা বলে), বসে থাকা বাকি লোক জন তা শুনে মজালুটে। ঐদিন দোকানে নিমাই নেই, ভানু দিদি দোকানে একা তবে কোন সমস্যা নাই। ভানু দিদি ভাবছে যে যা গুল মারে মারুক তাতে আমার লস নেই বরং লাভ, দুই একটা চা বিক্রি করতে তো পারবো এদের গুল মারামারিতে সময় অপচয় হওয়ার কারণে। এতো প্যাঁচাল করে সময় নষ্ট করে লাভ কি আসল কথাই আসি। গুলবাজ ভোলা নামের একজন বললো আমার দাদার একটা কুত্তা (কুকুর) ছিল। মানুষের মত কথা বলতো আর গরুর মত ঘাস খেত! দ্বিতীয় গুলবাজ সবুজ বললো আরে রাখ। তোর দাদার কুত্তার চেয়ে আমার নানার বিড়াল ছিল বড় ডিয়ারিং। পাড়ার যত কুত্তা ছিল, সব কুত্তার গায়ে একবার হলেও ওঠেছে!!!!! ওদের গুল মারা দেখে ভানু দিদি আর গুল না মেরে থাকতে পারলো না তখন ভানু দিদি বলে উঠল আরে তোমরা কি জানো আমি আগে এক এমপি মহাশয়ের গাড়ি চালাতাম একদিন হাকোবা মোড় হয়ে যশোর যাচ্ছিলাম পথে কলেজের মোড়ে এসে একটি কুকুরের সাথে এক্সিডেন্ট হলো, কুকুর টি মারা গেল। কিন্তু আমার মালিক এমপি সাহেব বড্ড কুকুর ভক্ত ছিলেন তাই তিনি বললেন যাও দেখ কুকুটির কি অবস্থা, আমি নেমে গেলাম এবং দেখলাম কুকুরটি মারা গেছে। এমপি সাহেব'কে বললাম কুকুরটি মারা গেছে। এমপি সাহেব বললেন যাও কুকুরটির মালিক কে খোঁজো ক্ষতি পূরণ দিতে হবে । যে কথা সেই কাজ, আমি চলে গেলাম কুকুরটির মালিক কে খুঁজতে পাশের ঝালঝাড়া গ্রামে। আমি গ্রামের ভিতরে যাওয়াতে, গ্রামবাসী আমার দিকে এগিয়ে এলো, এবং সবাই বলাবলি করতে লাগল ঐ দেখ দেখ শয়তান এমপির ড্রাইভার এসেছ। তারা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই, বললাম কুত্তার বাচ্চাকে আজ মেরে ফেলেছি পথে খুব জ্বালাচ্ছিল। এতে গ্রামবাসী খুশি হয়ে আমাকে ফুলের মালা পরিয়ে দিল। এবার ভানু দিদি বললো কি বুঝলে হু? ওরে তোরা যদি গুলবাজ তো আমিও গুলের রাজা। এভাবে হেসে খেলে বেশ কাটছিলো নিমাই, ভানু দিদি'র দিনগুলো ছেলে মেয়ে পাশে না থাকলেও এই গুল বাজ আড্ডা বাজ মানুষের সাথে। কিছুদিন পর থেকেই শুরু হলো মহামারি করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ কালো থাবার গুঞ্জন। আস্তে আস্তে আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়লো এই মহামারী। আর এই মহামারী ঠেকাতে সরকার ঘোষণা করলো লকডাউন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল নিমাই ভানু দিদির। একমাত্র আয়ের সম্বল ছোট্ট এই চায়ের দোকান লকডাউন বন্ধ হয়ে গেলে খাবে কি। নিমাই সরকারি চাকরি করতেন এবং ছেলে মেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত তাই ওয়ার্ড কমিশনার নিমাই ভানু দিদি কে কোন ভাতা ভোগী কার্ড করে দেয়নি। আসলে ওয়ার্ড কমিশনার জানেনা নিমাই- ভানুর বর্তমান অবস্থা। এরও কারণ আছে কমিশনার ভোটের সময় ছাড়া তেমন একটা মানুষের কাছে আসেন না। আর এসেই বা কি লাভ ভোট তো আর সেই আগের মতো নেই তাই নিমাই ভানু দিদির মতো ভোটারের কদরও নেই। শুরু হলো দেশ ব্যাপি সাত দিনের লকডাউন। ভানু দিদির চায়ের দোকান বন্ধ। ঘরে অল্পস্বল্প কিছু চালডাল আছে, ভাবছে সাতদিন পর লকডাউন শেষ হলে চায়ের দোকান খুললেই তো বেচাকেনা হবে। যায় হোক কষ্টমষ্ট করে দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। লকডাউনের সাত দিন পার হতে না হতে আবারো ঘোষণা এলো পনের দিনের লকডাউন। এদিকে আষাঢ় মাস ঘন ঘন ভারী বর্ষণে চায়ের দোকানের ভিতর পানি পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দোকানটি। লকডাইনের আট-দশ দিন পর নিমাই চায়ের দোকানটা খুলে ঝাড়ামোছা করতে লাগলো ভাবলো পানিতে দোকানের কাটকোট নষ্ট হচ্ছে একটু পরিস্কার করে রাখি। এমন সময় পুলিশের গাড়ি, কঠোর লকডাউন সরকারের নির্দেশ কোন অবস্থাতে দোকান খোলা রাখা যাবে না বিশেষ করে চায়ের দোকান। পুলিশ দেখলো নিমাই এর চায়ের দোকান খোলা। তাই নিমাই কে ধরে নিয়ে গেল থানায়। এই খরব শুনে কাঁদতে লাগলো ভানু দিদি। থানার সামনে ভানু দিদি কান্না দেখে মণিরামপুর এক মানবিক সাংবাদিক জানতে চাইলেন ঘটনা কি। ভানু দিদি'র কাছে ঘটনার সবকিছু শুনে পরদিন নিউজ হলো চা বিক্রিতা নিমাই ভানু অসহায় জীবনযাপনের ও পুলিশের ভুলবোঝাবুঝি। অসি সাহেব নিউজ পড়ে ছেড়ে দিলেন নিমাই কে এবং মানবিক পুলিশ ক্ষমা চেয়ে নিমাই কে পাঁচশত টাকাও দিলেন। সংবাদপত্রের এই নিউজ হওয়ার পর যশোরে বসবাসরত মনিরামপুরের এক দানবীর তিনিও খোঁজে খবর নিলেন এবং লোক মারফত এক মাসের চাল ডাল, মাছ তরকারি কিনে নিমাই ভানু'র বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। সেই সাথে কিছু নগদ টাকাও দিলেন, লকডাউন শেষে চায়ের দোকানটি মেরামতের জন্য। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এরপর মাঝে মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যানও খোঁজ খরব নিতে লাগলেন অসহায় নিমাই- ভানু দম্পতির। মণিরামপুর লকডাউনের সাথে সাথে বাড়ছে করোনাভাইরাসের কালো থাবা। সত্তর বছর বয়সী নিমাই হঠাৎ শনিবার রাতে করোনা আক্রান্ত। ভয়ে কেউ আর নিমাই ঘোষের বাড়িতে যাচ্ছে না। পৌরসভা থেকে নিমাই ঘোষের বাড়িতে লালফ্লাগ টানিয়ে দেওয়া হলো। ছেলে, ছেলের বউ ও পাড়া প্রতিবেশি সবাই ভয়ে। ৪৫ বছরের দাম্পত্য জীবন নিমাই ভানুর তাই স্বামীকে একা ফেলে ভানু দিদি আর কৈ বা যাবে। সে রাতে নিমাই ঘোষের খুবই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ভানু তার বড় ছেলে অজিত ঘোষকে ডাকলেন, কিন্তু বৌমা আসতে দিতে নারাজ ঘরে ছোট ছোট ছেলে- মেয়ে আছে। তাই বড় ছেলে অজিত ঘোষ মা ভানুকে বললেন মা আমি আসতে পারবো না! বাবার করোনা হয়েছে আমাদের বারান্দা থেকে তুমি চলে যাও তাড়াতাড়ি আর এসোনা। কোন উপায় না পেয়ে একটি ভ্যান ভাড়া করে ভানু নিমাই কে নিয়ে চলে গেলেন মনিরামপুর হাসপাতালে। হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তার কে সবকিছু খুলে বললেন ভানু । ডাক্তার সাথে সাথে ওয়ার্ডবয় এবং সিস্টার ডেকে তাড়াতাড়ি ভর্তি করিয়ে নিলেন হাসপাতালে। জীবনে ঝুঁকি নিয়ে ডাক্তার ছুটে আসলেন অক্সিজেন সিলিন্ডার হাতে নিমাই ঘোষকে বাঁচাতে। কিন্তু ততক্ষণে বেডে তুলতে না তুলতেই অক্সিজেন দেওয়ার আগেই নিমাই ঘোষ মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রী ভানু দিদি স্বামীর মরদেহটি নিজ বাড়িতে নিতে চাইলেও বাড়ির অন্যরা বলতে ছেলে, বৌমা, নাতি, পুতি করোনা আক্রান্ত হবে এ কারণে নিতে পারলো না। এমনকি বাড়ি থেকে ভানুর কোন ছেলে, মেয়ে ও আত্মীয় স্বজন মরাদেহটি নিতে আসলোনা হাসপাতালে। পরদিন শনিবার সকালে মরদেহটি হাসপাতালে এম্বুলেন্সে করে উপজেলার পৌর শ্মশানে নিয়ে যায় ভানু দিদি। সকালে শ্মশানে ভানু দিদি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে তাই শ্মশানের গেটে তালা ঝুলছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে দু’জন কর্মচারী শ্মশানের এক পাশে মরদেহটি নামিয়ে আবার ফিরে।গেল। এসময় ভানু দিদি শ্মশান কমিটির সদস্যদের তার স্বামীর মৃত্যুর বিষয়টি জানান, কিন্তু কেউ তাতে সাড়া দিলনা । নিমাই ঘোষের মৃত্যুর পর স্ত্রী ভানু দিদি তার পরিবারকে জানালেন ও বহু কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু, দুই ছেলে, ছেলে বউ ও নাতি করোনায় আক্রানত হবে এই ভয়ে তারা কেও শ্মশানে আসলো না। ফলে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও স্বামীর মরদেহটি ফেলে যেতে পারলোনা ভানু দিদি। বৃষ্টির গতি বাড়লে ভানু দিদি নিজেই মরদেহ সরিয়ে শ্মশানের পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় আশ্রয় নিল। সেখানে একাই পার করে দিলো পুরো দিন। সন্ধা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও মরদেহ সৎকারে শ্মশান কমিটি বা নিজ আত্মীয়-স্বজনরা আসলো না। ভানু দিদি'র কান্নাকাটি দেখে সন্ধায় স্কুলের নাইটগার্ড কামালের মাধ্যমে জানতে পারে মনিরামপুর একটি মরদেহ সৎকার ফাউন্ডেশন সংগঠন। ঐ সংগঠনের স্থানীয় কয়েকজন মুসলিম যুবক ও শ্মশান কমিটির এক যুবক মিলে নিমাই ঘোষের মরদেহটি মুখাগ্নি করে শ্মশানের পাশে সমাহিত করলো। বি:দ্র: গল্পটিতে কাল্পনিক চরিত্র, নাম ও সংগৃহীত ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। দয়া করে কেও কপি করবেন না। ভালোলাগলে শেয়ার ও মন্তব্য করে জানাবেন কেমন হলো।।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: