নতুন প্রজন্মের আলোচিত লেখক অলিয়ার রহমান এর লেখা- রূপকথার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২১ ০৮:০০

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২১ ০৮:০০

ছবি সমসাময়িক

আজ ফাল্গুন মাসের বাইশ তারিখ। এই সময় সাধারনত বাংলাদেশে বছরের সবচেয়ে মধুর সময় বিরাজ করে। না শীত - না গরম আবহাওয়া, গাছে গাছে কচিপাতা, মন ব্যাকুল করা নানা রঙের ফুল, হাজার পাখির কলতান - সবকিছু মিলে এক স্বর্গীয় পরিবেশ। এই সময় সমস্ত জীবকূল পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অপার আনন্দ অনুভব করে। এবছর ফাল্গুনের বাইশ তারিখটা খানিকটা অন্যরকম। দু'দিন থেকে প্রচন্ড গরম পড়ছে। মনে হচ্ছে ফাল্গুন না- আজ জৈষ্ঠ্যমাসের বাইশ তারিখ, কাঁঠাল পাকা গরম। গরমের সাথে সাথে রোকেয়ার মেজাজ উঠানামা করছে। তিনি এসির টেম্পারেচার আঠারোতে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। কিছু সময় ঘুমানো দরকার - ঘুমালে মাথা ধরাটা কমতো, সাথে মেজাজের পারদটাও নেমে যেতো খানিকটা। তাছাড়া আজ সারারাত জাগতে হবে তাকে । সবাই মিলে কুয়াকাটা যাবার প্লান করা হয়েছে। গাড়ী ছাড়বে রাত দশটায় - তাহলে ভোর বেলায় কুয়াকাটা পৌছানো যাবে। রোকেয়া গাড়ীতে ঘুমাতে পারেন না, কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। তিনি একটা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন এবং একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুম ভাঙলো বিকাল পাঁচটায়। তার জোহরের নামাজ কাজা হয়েছে, আছরের ওয়াক্তও যায় যায় করছে। তিনি অজু করে তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ে নিলেন। একটু পরেই মাগরিবের আজান দিবে। রাতুলের বাবা এখনো বাসায় ফেরেনি। এই একটা মানুষ - জীবনে কাজ ছাড়া আর কিছুই বুঝলোনা। সারারাত জার্নি করে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি বাসায় এসে যে একটু রেষ্ট নেবে - সেই সময় তার হাতে নেই। রাতুলের বাবা রায়হান সাহেব একসময় ভাটার ব্যবসা করতেন। মনিরামপুরে তার ষ্টার ব্রিকস নামে একটা ভাটা ছিলো। মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় - ওনারটা হয়েছে বটগাছ। রায়হান সাহেবের এখন সাভারে ত্রিশ বিঘা জমির উপর সিরামিকের ফ্যাক্টরি, নাম - ষ্টার সিরামিক। তার ফ্যাক্টরিতে তৈরি টাইলস বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলা সহ নেপাল ও পাকিস্হানে রপ্তানি হয়। রায়হান সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত আটটায়। তিনি লম্বা সময় নিয়ে সাওয়ার নিলেন। গাড়ি ছাড়বে রাত দশটার দিকে। হাতে এখনো বেশ খানিকটা সময় আছে। তিনি ড্রয়িংরুমে ঢুকে ডিসকভারি চ্যানেলটা চালু করে দিলেন। বাড়ি ভর্তি লোকজন - সবাই কুয়াকাটার যাত্রী। প্রায় একমাস হলো তার মেয়ে অহনা অনার্স শেষ করে বাসায় এসেছে। অহনার বর সাফিন এক মাসের ছুটিতে দুবাই থেকে ফিরেছে গত সপ্তাহে। তার ছেলে রাতুল এসেছে গত পরশু। তার একমাত্র শ্যালক আসগার তার স্ত্রী, দুই মেয়ে আর মেয়েদের এক বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে গতকাল রাতে। রায়হান সাহেব ভীড় খুব একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে দেখা হলে সবার সাথে হাসি হাসি মুখ করে কথা বলছেন তিনি। মোট মাইক্রোবাস যাচ্ছে তিনটা। এক গাড়ীতে আসগারের পরিবার, অন্য গাড়ীতে রাতুল, অহনা আর সাফিন এবং আরেকটা গাড়ীতে রায়হান সাহেব আর রোকেয়ার যাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। অবশ্য রায়হান সাহেবের সাথে তার পি এস মাসুদ যাচ্ছে একই বাসে। মোট তিনদিনের ট্রিপ, ফ্যাক্টরি খোলা - সেই কারণেই মাসুদকে সাথে নেওয়া। ব্যবসার এই অবস্হায় তিনদিন ব্যবসা থেকে দুরে থাকা তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। মাল পত্র সব গাড়ীতে তোলা হয়েছে। রাত এগারোটা বেজে গেছে, এখনো গাড়ী ছাড়া যাচ্ছে না। অহনার সাজগোজ এখনো শেষ হয়নি। বিয়ের পর এই প্রথম সে বরের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। আসগর তার পরিবার নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসে আছে। তাদের গাড়ির পিছনে ছোট এক ডেক খাশির তেহেরি - রাস্তায় ক্ষুধা লাগলে সবাইকে পরিবেশন করা হবে। আসগরের ধারণা - তার পরিবার ছাড়া বিষয়টা কেউ জানেনা। সে আপা দুলাভাইকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। সারপ্রাইজ দেবার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে। গাড়ি ছাড়লো রাত বারোটায়। প্রথমে রাতুলদের গাড়ি, মাঝখানে আসগর এবং সবার পিছনে রায়হান সাহেবদের গাড়ি যাচ্ছে আরিচা ঘাটের দিকে। ফেরিটা পার হতে পারলেই ওইপারে টানা রাস্তা - তখন কুয়াকাটা যেতে আর সময় লাগবেনা। অবশ্য লেবুখালিতে ছোট্ট একটা ফেরি আছে - ওটা পার হওয়া দশ থেকে পনের মিনিটের মামলা। রায়হান সাহেবরা রওনা দিয়েছেন আধা ঘণ্টা হয়ে গেছে । রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দু,একটা নাইট কোচ পাশদিয়ে শাঁই করে বের হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে সুন্দর পরিবেশ, তবুও রোকেয়ার কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। গাড়ির ভিতরে একটা গুমোট গন্ধ, কেমন যেন টক টক। গন্ধটা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। রোকেয়া বললেন -"মজিদ মিয়া -রওনা দেবার আগে গাড়ি পরিস্কার করোনি? গাড়িতে গন্ধ কিসের?" "জ্বি ম্যাডাম - আসার আগে সার্ভিস সেন্টার থেকে ভালো করে ক্লিন করে আনছি ।" " তাহলে গন্ধ কিসের?" ড্রাইভারের পাশে পি এস মাসুদ বসে আছে। মাসুদ বললো -"ম্যাডাম, অভয় দিলে আমি বলতে পারি। আমাদের ড্রাইভারের পেট খারাপ করেছে। আজগর স্যার সন্ধ্যার পর মজিদ মিয়াকে তেহেরি খেতে দিয়েছিলেন। মজিদ মিয়া এক বৈঠকে তিন প্লেট তেহেরি খেয়ে নিয়েছে। আসগর স্যার ঐ তেহেরি সকাল এগারোটায় রান্না করায়ে এনেছেন "ফ্রেশ মিট" হোটেল থেকে। আমার ধারণা গরমে ঐ তেহেরি নষ্ট হয়ে গেছে। খাবার একঘন্টা পর থেকে মজিদ মিয়ার এই অবস্থা। তার চারপাশের সবকিছু টক হয়ে যাচ্ছে। আর এখন তো গাড়ির গ্লাস বন্ধ। তার এই পেট নিয়ে আমরা কুয়াকাটা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো বলে আমার মনে হয়না। যে কোন সময় তার পেট নেমে যেতে পারে। আর সেরকম কিছু না হলেও আমার নির্ঘাত ডায়রিয়া হয়ে যাবে - আমি মজিদ মিয়ার পাশে বসা।" হঠাৎ রোকেয়ার প্রচন্ড বমি পেয়ে গেলো। তিনি বললেন - "গাড়ি থামাও, আমি বমি করবো।" রায়হান সাহেব বললেন - "তুমি বমি করবে কেন - তুমিও কি তেহেরি খেয়েছো? "আমার সাথে বাজে কথা বলবেনা। গাড়ি থামাতে বলছি - থামাও, আমার বমি আসছে - বমি করবো।" "বমি করার জন্য গাড়ি থামাতে হবে কেন? গাড়িতে পলিথিন আছে, পলিথিনে বমি করো।" "গাড়ি থামাও, আমি এই গাড়িতে যাবোনা, আমি আসগরের গাড়িতে যাবো। "ঠিক আছে, আধাঘণ্টা অপেক্ষা করো, গাড়ি ফেরিতে উঠলে তখন গাড়ি চেঞ্জ করে নিও।" "আমি এক মিনিটও অপেক্ষা করতে পারবোনা। গাড়ি থামাও।" "আরে কি মুশকিল! আমাদের গাড়ি সবার পিছনে। আমরা থেমে কি করবো? আগে ওদের গাড়ি থামাতে বলো। তোমার বুদ্ধিও তো তোমার ভায়ের মতো হয়ে গেছে।" "আমার ভাই আবার কি করলো? " " কি করেছে বুঝতে পারছো না? সকাল দশটায় তেহেরি রান্না করে বসে আছে, আর রাত্রি বেলায় সেই তেহেরি সবাইকে ডেকে ডেকে খাওয়াচ্ছে। এই সাইজের একটা গাধা সংসারে থাকলে পাকা ধানে মই দেয়ার জন্য আর বাইরের লোক লাগবেনা - যত্তসব।" রোকেয়া অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। মনে মনে ভাবলেন- বাসায় ফিরে এর ঝাল তিনি মেটাবেন। তিনি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আসগরকে ফোন দিলেন। "হ্যালো আসগর " "হ্যাঁ বুবু বলছি, তুমি ভালো আছো" "কিছুক্ষণ আগেই তো বাসা থেকে একসাথে বের হলাম। এখন আবার ভালো আছি কিনা জিজ্ঞাসা করছিস কেন?" "আমরা ভালো নেই বুবু - এজন্য জিজ্ঞেস করছি।" "তোদের আবার কি হলো?" "আমাদের গাড়ি হরিহর নদী হয়ে গেছে বুবু" " মানে কি?" "মানে খুব সহজ বুবু - নিতু, মিতু আর ওদের মা বমি করে গাড়িতে হাঁটু পানি করে ফেলেছে। সন্ধ্যার পর তেহেরিটা খাওয়া ঠিক হয়নি বোধ হয়। খাবার সময় ওরা বলছিলো খেতে টক টক লাগছে। আমি বললাম - টাটকা তেহেরি টক লাগবে কেন , আচারের জন্য হতে পারে। এখন সবার অবস্থা টাইট। টক গন্ধে গাড়িতে বসা যাচ্ছেনা।" "তোর এই রকম হবার দরকার আছে। কোন বুদ্ধি নেই, মাথা ভর্তি গোবর। বলা নেই কওয়া নেই - সকাল আটটায় তেহেরি রান্না করে বসে আছে। গরমে মানুষ টক হয়ে যাচ্ছে, আর তেহেরি টক হবে না - কতো বুদ্ধি !! গাধা একটা।" রোকেয়া রাতুলকে ফোন করলেন। "হ্যালো রাতুল" "বলো মামনি " " গাড়িটা থামা তো, আমি তোদের গাড়িতে যাবো।" "বাবার সাথে ঝগড়া করেছো?" "হ্যাঁ করেছি, তোর কোন সমস্যা আছে ?" "কোন সমস্যা নেই, মাঝে মাঝে একটু মান অভিমান না হলে সংসারটা জমে না।" "চুপ থাক, বুড়ো ধাড়ির সাথে আবার মান অভিমান।" " তোমার বয়সটাও কিন্তু থেমে নেই মামনি।" " তুই কি বলতে চাচ্ছিস - আমি বুড়ী? তোদের মানুষ করে আজ আমাকে এইকথা শুনতে হলো! যা তোদের কারো আমার দরকার নেই।"রোকেয়া চোখ মুখ লাল করে ফোনটি কেটে দিয়ে বললেন -"আসগরের মতো আমার ছেলে মেয়ে দুটোও হয়েছে গাধা। মাথা ভর্তি গোবর।" পাশ থেকে রায়হান সাহেব বললেন -" তুমি আসগরকে গাধা বলছো ঠিক আছে,- কিন্তু রাতুলকে বলছো কেন? রাতুলের মতো ভালে আর মেধাবী ছেলে তুমি আর একটা খুঁজে বের করো তো! সে মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে নিউরো সার্জারি এ্যান্ড মেডিসিনে পি এইচ ডি করে দেশে ফিরেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এযাবৎ কালে যতোগুলো ভালো ডাক্তার তৈরি করেছে - রাতুল তাদের অন্যতম। ওকে গাধা বললে যে তোমারই অপমান হয় - সেটা বোঝ?" " ওরে বাবা - ছেলেকে খারাপ বলা যাবে না। দিনরাত এক করে ছেলেকে মানুষ করে দিলাম, এখন সারাদিন ফটর ফটর।" রোকেয়ার ফোন বাজছে - রাতুলের ফোন । "কি বলবি বল।" "মামনি, তোমার সমস্যাটা কি আমাকে বলবে?" "তোকে বলে কি করবো - তুই সমাধান করে দিবি? সব সমস্যার সমাধান তোর জানা? তুই মহাজ্ঞানী অতীশ দীপংকর?" " মামনি তুমি রেগে আছো বলে সমাধান পাচ্ছোনা। রাগ না করে আমাকে বলো - তুমি অস্থির হয়ে আছো, আমার ভালো লাগছে না।" "আমাদের ড্রাইভারের পেট নষ্ট হয়ে গেছে। আমি গাড়িতে বসতে পারছিনা। ওদিকে তোর মামাদের গাড়িতে বমি-টমি করে একাকার। তোদের গাড়িতে যাওয়া ছাড়া কোন গতি নেই।" " মামনি -তাহলে ড্রাইভার চেঞ্জ করে নাও, গাড়ি বদলাবার দরকার কি? রাজিবকে বলো তোমাদের গাড়িতে চলে আসতে, আর মজিদ চাচাকে মামাদের গাড়িতে পাঠিয়ে দাও।" "তাইতো , এই কথা আমার মনে আসেনি কেন? আচ্ছা তুই রাখ - আমি দেখছি।" গাড়ি ফেরিতে উঠার পর এক-এক করে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। নদীর পানি দিয়ে গাড়ি পরিস্কার করা হলো, ড্রাইভার বদল করা হলো এবং সর্বোপরি রাতুল ঔষধ দিয়ে সবাইকে চাঙা করে দিলো। আসগর শুধু তেহেরির বিষয়টা নিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। তেহেরি দিয়ে ভকভক করে গন্ধ বের হচ্ছে। রাতুল ওর মামার কাছে এসে বললো -" মামা, তেহেরিগুলো নদীর পানিতে ফেলে দাও - মাছে খেয়ে ফেলবে। এগুলো এখন আর কেউ খেতে পারবেনা।" "ঠিক আছে , তুই রাজিব আর মজিদ মিয়াকে বলে একটা ব্যাবস্থা কর। আমি আর এসবের মধ্যে নেই। পুরো প্ল্যানটাই মাটি হয়ে গেছে। আপার কাছে সমানে বকা খাচ্ছি। কান ধরেছি - বাকি জীবনে আর কোনদিন তেহেরি রান্না করবোনা, রান্না তো দুরে থাক - তেহেরির পাশ দিয়েও হাঁটবোনা। আই প্রমিজ।" এখন রাত দু'টো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। গাড়ি ফেরী পার হয়ে অনেক দুর চলে এসেছে। রাজবাড়ীর চৌরাস্তা পার হয়েছে পনের মিনিট হয়ে গেছে। আর কিছুটা সামনে গেলে বামদিকে ফরিদপুরের রাস্তা। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রায়হান সাহেবদের কিছু সময় যাত্রা বিরতি করার কথা। ওয়াসরুমে যাবার প্রয়োজনটা সারা হবে, সাথে সামান্য চা-নাস্তা। রাতুলদের গাড়ি যথারীতি সবার সামনে। রাতুল ড্রাইভারের পাশে বসা। আজ বোধহয় কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী। আকাশে এত্তোবড় একটা চাঁদ, কোন কুয়াশা নেই। সেই কারণে চাঁদের আলোয় ঘুমিয়ে পড়া দুরের বৃক্ষরাজিকেও অনেক দিনের চেনা বলে মনে হচ্ছে আজ। কোলাহল মুক্ত ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির আলোয় বহুদুর পর্যন্ত দেখা যায়। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল রাতুল। রাস্তার পাশে একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন - সাথে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে। তাদের পাশে একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক মহিলাটি তার ডানহাতটা সামনের দিকে উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, ছেলেটা তুলেছে দুই হাত। রাতুল ফরিদকে (ড্রাইভার) গাড়ি থামাতে বললো। ফরিদ বললো -" স্যার, সেটা কি ঠিক হবে ? যদি কোন ঝামেলা হয়?" "ঝামেলা হলে হবে, তুমি গাড়ি থামাও " কিছুটা ব্যাকে এসে রাতুলদের গাড়ি ভদ্রমহিলার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাতুল বললো -"কোন সমস্যা আন্টি ?" "জ্বি বাবা, আমার পোতনীটা মারা যাচ্ছে। তোমরা তাকে বাঁচাও, আমি সারাজীবন তোমাদের কেনা গোলাম হয়ে থাকবো।"ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে কাঁদছেন। তার কান্না দেখে বাচ্চা ছেলেটাও কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। " কি হয়েছে আপনার পোতনীর? কোথায় সে?" "বিকাল বেলায় ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলো। যশোর সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা বললো - মেয়ের অবস্হা ভালো না - মাথায় আঘাত পেয়েছে, তাকে দ্রুত ঢাকার পঙ্গুতে নিতে হবে। মাইক্রো ভাড়া করে ঢাকা যাচ্ছিলাম। এখানে এসে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। এক ঘণ্টার উপরে দাঁড়িয়ে আছি। কতো গাড়ি যাচ্ছে, কেউ সাহায্যের জন্য দাঁড়ালো না। ড্রাইভার ছেলেটাও গাড়ির জন্য অনেক জায়গায় ফোন করলো - কেউ ফোন উঠাচ্ছেনা।" রাতুল গাড়িথেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রোর কাছে এগিয়ে গেল। বোরকা পরিহিতা একজন মহিলার কোলের উপর সাত-আট বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে শুয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে এবং মাঝ মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে । মহিলার চোখদুটো ভেজা। মেয়েটার পা দু'টো হাঁটুর নীচ থেকে অনেকখানি ফুলে গেছে। চোখ দু'টো লাল, মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে - মেয়েটার পা দু'টো ভেঙ্গে গেছে। মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। ওকে দ্রুত হসপিটালাইস্ড করতে হবে, হাতে সময় খুবই কম। ততক্ষণে রায়হান সাহেবদের বাকি দু'টো গাড়ি সেখানে হাজির হয়েছে। রাতুল রায়হান সাহেবের কাছে গিয়ে বললো - "বাবা, আমার আপাতত কুয়াকাটা যাওয়া হচ্ছেনা। এই মেয়েটাকে নিয়ে দ্রুত ঢাকায় যেতে হবে। ওর অবস্থা অনেক জটিল হয়ে গেছে। দেরি করলে মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না।" রায়হান সাহেব তার ছেলেকে খুব ভালো করেই চেনেন। তিনি জানেন - তাকে নিষেধ করে কোন লাভ নেই। রোকেয়া বললেন - "এতোদিন অপেক্ষা করছি তোর জন্য। আর আজ তোকে ছাড়া বেড়াতে চলে যাবো?" রাতুল বললো-"মামনি, তোমরা যাও। তিন দিনের ট্রিপ তো, পারলে আমি মেয়েটির চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে আগামীকাল রাতে আবার রওনা দিবো। কিন্তু এখন মেয়েটিকে এভাবে ফেলে আমি যেতে পারবোনা।" রায়হান সাহেবদের গাড়ির পেছনের সিটগুলো আগেই ফাঁকা ছিলো। অহনা আর সাফিন সেখানে গিয়ে বসলো। রাতুল ফরিদকে বললো গাড়ি ঢাকার দিকে ঘুরাবার জন্য। ওদের গাড়ির মালপত্র রাতুলের গাড়িতে তোলা হলো। মেয়েটিকে খুব সাবধানে গাড়ি বদল করা হলো। ততক্ষণে রাতুল ওদের পরিচয় জেনে গেছে। অসুস্থ মেয়েটির নাম ইরাবতী। ছোট ছেলেটার নাম ফাহিম, ইরাবতীর ভাই। ভদ্রমহিলা ওদের দাদী আর মেয়েটির মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকা মহিলাটা ওদের মা। ওদের সঙ্গে কোন পুরুষ মানুষ কেন নেই - সেটা একটা রহস্য। রাতুল ভদ্রমহিলার পরিবারটিকে গাড়িতে তুলে ঢাকার দিকে রওনা দিলো। ভদ্রমহিলার কান্না যেন কিছুতেই থামছেনা। এই প্রথমবার ওদের মায়ের গলা শোনা গেল। তিনি তার শ্বাশুড়ীর দিকে মুখ ফেরায়ে ভেজা গলায় বললেন - "আর কাঁদবেন না আম্মা। এযাত্রা ইরার আর কোন সমস্যা হবেনা।" একথা তিনি কেন বললেন - গাড়িতে বসা কেউই তা বুঝে উঠে পারলোনা। ইরাবতী বোধ হয় আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে । তাকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসার ভিতরে আনতে হবে। তার পা ভেঙে গেছে সেটা সমস্যা না, সমস্যা হলো তার ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি (টি বি আই) । সে ছাদ থেকে পড়ে গেছে বিকেলে। যদি তখন থেকে মাথায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে থাকে তাহলে তার বাঁচার আশা ক্ষীণ হয়ে যাবে। রাতুল ইরাবতীর পায়ের কাছে বসে আছে।সে তার সিনট্রম বোঝার চেষ্টা করছে। বেশি রক্তক্ষরণ হলে তার প্রেসার কমে যাবে। ইরাবতীর প্রেসার ঠিক আছে তো? সে ফরিদের কাছথেকে তার ব্যাগটা নিয়ে নিলো এবং ব্যাগথেকে স্ফিগমোম্যানোমিটারটা বের করলো। ডিজিটাল একটা মেশিন। এটা দিয়ে একই সাথে প্রেসার এবং হার্টবিট মাপা যায়। মেশিনটা বের করতেই মেয়েটির সহযাত্রীরা জেনে গেল - রাতুল একজন ডাক্তার। হঠাৎ করে তারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন -"আপনাকে আল্লাহ পাক আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন আমার ময়না পাখিটার জান বাঁচানোর জন্য। আল্লাহর অনেক দয়া। ভেবেছিলাম - আমার জানটাকে বোধ হয় আর বাঁচাতে পারবোনা। সন্ধ্যা থেকে আল্লাহর দরবারে অনেক কেঁদেছি। আল্লাহ এই অধমের ডাক শুনেছেন।" গাড়ি দ্রুত গতিতে যাচ্ছে ফেরিঘাটের দিকে। রাতুল ইরাবতীর মাকে ইশারা করে ওর হাতটা উঁচু করে ধরতে বললো প্রেসার চেক করার জন্য। প্রেসার এবং হার্টবিট দু'টোই ঠিক আছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রাতুল। মনে হচ্ছে ওর "টি বি আই " ফাস্ট স্টেজে আছে। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে বেষ্ট রেজাল্ট বের করে আনা যেতো। রাতুল প্রথমে ফোন করলো ওর বাবাকে। সে জানে তার বাবার অনেক ক্ষমতা। "হ্যালো বাবা " "হ্যাঁ রাতুল শুনছি " " বাবা আমরা ফেরিঘাটের প্রায় কাছে চলে এসেছি। তুমি একটু ব্যাবস্থা করে দাও -যেন আমরা সাথে সাথে ফেরিতে উঠতে পারি। কোন অবস্হায় ফেরি মিস করতে পারবোনা বাবা।" "ঠিক আছে, আমি দেখছি।" রাতুল জানে তার বাবার দেখা মানেই কাজ হয়ে গেছে। এরপর সে ফোন করলো ডাঃ ফরহাদকে। রাত প্রায় চারটা। এতোরাতে ফরহাদ ফোন ধরবে কিনা কে জানে। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফরহাদের গলা শোনা গেল। "কিরে রাতুল, এতোরাতে ফোন করেছিস - কোন সমস্যা? " হ্যাঁ, একটু সমস্যা হয়েছে । আমার এক আত্নীয়ের মেয়ে খুব অসুস্থ। ওকে নিয়ে ঢাকায় আসছি। আচ্ছা, পঙ্গুতে আমাদের পরিচিত কেউ আছে? একজন ভালো অর্থোপেডিকস সার্জন দরকার - সার্জারি করতে হবে।" "তুই পেশেন্ট নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে চলে আয়। আমাদের ইমাদুল স্যার আবার ঢাকা মেডিকেলে জয়েন করেছেন। তুই বললেই স্যার সার্জারি করতে চলে আসবেন।" "বলিস কি! ইমাদুল স্যার এখন ঢাকা মেডিকেলে। স্যার কবে জয়েন করেছেন?" "এইতো - এই মাসের এক তারিখে।" "গুড, তুই ফ্রেশ হয়ে একটু মেডিকেলে চলে আয়। তোর ড্রাইভার আছে বাসায়?" " সমস্যা নেই , এখন রাস্তা সব ফাঁকা। আমি একাই গাড়ি নিয়ে আসতে পারবো। " " আচ্ছা শোন - তুই আসার সময় ডাঃ মৌমিতাকে একটু সাথে করে নিয়ে আয়। একটা এম আর আই করতে হবে। আমার কথা বলিস - ও না করবেনা।" " আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এদিকটা দেখছি। তুই পেশেন্ট নিয়ে সাবধানে আয়।" " ও কে, বাই।" "বাই " গাড়ি ফেরি পার হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ। মাঝে মানিকগঞ্জ থেকে ইনজেকশন কিনে ইরাবতীর শরীরে পুশ করেছে রাতুল। ইরাবতীর পায়ের ব্যাথা এখন অনেকটা কম । দুর থেকে ফজরের আজান কানে ভেসে আসছে। ইরাবতীর মা দেখলো - ইরার একটা হাত ধরে বসে আছে রাতুল আর ইরা গভীর মমতা নিয়ে তাকিয়ে আছে রাতুলের দিকে। রাতুল ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো , কিন্তু অন্ধকারে ওর মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। রাতুল মাথার উপর লাইটটা জ্বেলে দিলো। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললো - এখন কেমন লাগছে ইরাবতী " "পায়ে ব্যাথা" "ব্যাথা কি অনেক বেশি" " এখন একটু কম " " গুড। তোমার কি ভয় করছে ?" " একটু " " কোন ভয় নেই । এই যে তোমার ডাক্তার আংকেল আছে , ঔষধ দিয়ে তোমাকে ভালো করে দেবে।" " আচ্ছা " রাতুল ওদের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো - "ইরাবতী কি পড়ে যাবার পর একবারও বমি করেছে?" "জ্বি না। " "কান বা নাক দিয়ে কি রক্ত বের হয়েছে?" " না, সেসব কিছু হয়নি। তবে কিছুক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলো। আমার ধারণা - গাড়ীতে ওঠার পর সে আর অজ্ঞান হয়নি। মাঝে মাঝে ঘুমাচ্ছে, আবার ব্যাথায় জেগে যাচ্ছে।" ইরাবতীর মায়ের ব্যাগের ভিতরে ফোন বাজছে। তিনি ফোনটা বের করে শ্বাশুড়ীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন -"আম্মা, কথা বলেন - বাবার ফোন।" ভদ্রমহিলা স্বামীর ফোন ধরে আবার কিছুক্ষণ কেঁদে নিলেন। তারপর কাঁপা গলায় বললেন - "আর চিন্তা নেই। আল্লাহ পাক তোমার ডাক শুনেছেন। যে ব্যাবস্থা হয়েছে - - তারচেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারতোনা। তুমি সকালে টাকার জোগাড় করে ঢাকায় চলে আসো। ফজরের নামাজ পড়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করো , আল্লাহ পাককে কৃতজ্ঞতা জানাও।" উনি আবার কাঁদছেন। রাতুল বললো - "আন্টি, আর কাঁদবেন না প্লিজ। আপনি কাঁদলে বাচ্চা দুটো কষ্ট পাচ্ছে। ইরাবতীর জন্য যা করার - আমি করছি।" ভদ্রমহিলা বললেন -" সে তো দেখতে পাচ্ছি বাবা। আপনি যা করছেন - ওদের বাবা বেঁচে থাকলেও এতোটা করতে পারতোনা।" " কি হয়েছিলো আপনার ছেলের?" "মাথায় টিউমার হয়েছিলো বাবা। কতো চেষ্টা করলাম। আমার বাপটারে সাথে নিয়ে আমি চেন্নাই পর্যন্ত গিয়েছিলাম , তবুও বাঁচাতে পারিনি। ওই একটাই সন্তান ছিলো আমার। এখন এদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা বেঁচে আছি।" মহিলার চোখদুটো আবার পানিতে ভরে উঠেছে। রাতুল বলার মতো কোন ভাষা খুজেঁ পেলোনা। ইরাবতীর মাও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য রাতুল বললো- "আংকেলকে সাথে আনলেন না কেন?" " টাকার জোগাড় করতে পারেনি বাবা । মাত্র বার হাজার টাকা আর বউমার সর্বশেষ গলার হারটা হাতে নিয়ে আমরা চারজন মানুষ ঢাকায় রওনা দিয়েছি। তার মধ্যে মাইক্রো ভাড়া করেছিলাম নয় হাজার টাকায়। আপনার আংকেলকে বলেছি - জমি বন্দক রেখে হলেও টাকা জোগাড় করতে। আল্লাহর উপর ভরসা করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। আর কোন উপায় ছিলোনা আমাদের।" " এসব কথা থাক মা "- ইরাবতীর মা বললেন। রাতুল বললো -" মানুষের খারাপ দিন সব সময় থাকেনা আন্টি। মনকে শক্ত রাখেন, ভালো সময় একদিন ফিরবে ইনশাআল্লাহ।" " আমাদের এমন দিন ছিলোনা বাবা। স্বচ্ছলতা ছিলো অনেক, বউমার গা ভর্তি ছিলো গয়না। ছেলেটার চিকিৎসা করাতে সব শেষ হয়ে গেছে। এর পরও বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছেনা। কতোটা বিপদে পড়লে দুইজন মেয়ে মানুষ প্রায় খালি হাতে দু'টো দুধের বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় রওনা দিতে পারে - ভাবতে পারেন?" রাতুলের হঠাৎ মনে হলো - সারারাত বোধহয় এদের কিছুই খাওয়া হয়নি। ওনারা না হয় ক্ষুধা সহ্য করতে পারেন, কিন্তু ফাহিম? ওর তো পৃথিবীর বাস্তবতা বুঝার বয়স এখনো হয়নি। কেমন যেন বুকটা হু হু করছে রাতুলের। চোখদুটো ভিজে উঠলো তার- কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো দ্রুত। গাড়ি ঢাকায় ঢুকে গেছে। আধাঘণ্টার ভিতরে তারা ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে যাবে। ইমাদুল স্যারকে এখনো ফোন করা হয়নি। রাতুল ফোনটা বের করে স্যারকে ফোন করলো। "আস সালামুআলাইকুম স্যার। স্যার রাতুল বলছিলাম। " ওয়ালাইকুম আস সালাম। আরে হিপোক্রেটিস, তুমি বাংলাদেশে কবে এলে?" " গত পরশু ভোর চারটায় দেশে ফিরেছি। আপনি কেমন আছেন স্যার।" " আমি ভালো আছি। তোমার কি খবর বলো।" " জ্বি স্যার - আমি ভালো আছি। স্যার ছোট্ট একটা প্রয়োজনে আপনাকে ফোন করেছি। " " তুমি এতো হেজিটেট ফিল করছো কেন? কি করতে হবে বলো।" " স্যার - পায়ে একটা সার্জারি করতে হবে। আমার এক বন্ধুর মেয়ে ছাদ থেকে পড়ে গেছে। আমরা স্যার "এম আর আই " রিপোর্ট দেখে আপনাকে জানাবো। যেহেতু ছাদ থেকে পড়েছে - ওর নিউরো সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। সেরকম কিছু হলে আমিই সার্জারিটা করে দেবো। সেক্ষেত্রে আপনি স্যার বারোটার দিকে এসে পায়ের সার্জারিটা করে দিয়ে যাবেন। আর যদি মাথায় ইনজুরি না হয়ে থাকে - তাহলে আমি ঘণ্টা খানিক পরে আপনাকে ফোন দেবো।" " ঠিক আছে রাতুল, পরিস্হিতি আমাকে জানাও। আজ আমার অফ ডে। I will do everything for you.'" " Thank you Sir." রাতুলদের মাইক্রো ঢাকা মেডিকেলের গেইটে চলে এসেছে। গেইটে ডাঃ ফরহাদ, মৌমিতা, আর নিখিল রায় দাঁড়িয়ে আছে। সবাই দৌড়ে এসে রাতুলকে জড়িয়ে ধরলো। দুইজন ট্রলিম্যান ছুটে এলো ট্রলি নিয়ে, সাথে দুইজন নার্স। তারা দ্রুত ইরাবতীকে"এম আর আই" করার জন্য বি ব্লকের চার তলায় নিয়ে গেল। রাতুল ও তার বন্ধুরা গেল ওদের সাথে। ফাহিমের আম্মু ও দিদিমার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেননা তারা । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে - "এসব কিছু স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে, ঘুম ভাঙলেই দেখবে - তারা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে কোন একজন মানুষের সামান্য কৃপা পাবার আশায়।" ইরাবতীকে "এম আর আই "মেশিনে ঢোকাবার প্রস্তুতি চলছে। একজন নার্সের দিকে তাকিয়ে রাতুল বললো - "ওকে মেশিনে দেবার আগে রক্ত নিয়ে রক্তের পরীক্ষাগুলো করে ফেলো।" " জ্বি স্যার, আমি এক্ষনি ব্লাড নিচ্ছি।" " কি কি পরীক্ষা করতে হবে লিখে দেবো?" " না স্যার , ফরহাদ স্যার আগেই লিখে দিয়েছেন।'' " গুড, দ্রুত কাজ করবে। "এম আর আই" রিপোর্ট আর ব্লাডের রিপোর্ট যেন একসাথে আমার হাতে আসে।" রাতুল ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললো - " কেবিন দিয়েছিস কোথায়?" " ফারজানা ম্যাডামকে তোর কথা বলে পাঁচ তলার ডানপাশের কোনায় দুই রুমের ভি আই পি কেবিনের চাবি নিয়ে এসেছি।" " এক্সিলেন্ট, দে - চাবি দে। ওনাদের রুমে রেখে আসি।" "রুম খোলা আছে । রুম পরিস্কার করার জন্য আমি লোক পাঠিয়ে দিয়েছি।" " তাহলে আমি উপর থেকে আসছি। তুই একটা টি বয়কে রুমে পাঠিয়ে দে , আর কাউকে বল - ওদের মালামাল গুলো রুমে দিয়ে আসতে।" " আচ্ছা, তুই যা - আমি দেখছি।" রাতুল ফাহিম আর ওর দাদিমাকে নিয়ে কেবিনে চলে এলো। ফাহিমের মা -মেয়েকে একা রেখে আসতে রাজি হলোনা। একটা বয় এসে দরজায় টোকা দিলো। রাতুল দরজা খুলে দেখে ওপাশে রবিন দাঁড়িয়ে আছে। "আসসালামু আলাইকুম স্যার" "ওয়ালাইকুম আস সালাম। কি খবর রবিন?" "জ্বি স্যার, খবর ভালো। স্যার কবে দেশে আইচেন?" " এই তো তিনদিন হলো। তোমার দিদি বিয়ের পরে ভালো আছে তো?" " জ্বি স্যার, দশদিন আগে দিদির একটা ছেলে হয়েছে স্যার।" "ওয়াও, গ্রেট নিউজ। মিষ্টি খাবো কবে?" " জ্বি স্যার - মিষ্টি অবশ্যই খাওয়াবো স্যার।" " আচ্ছা রবিন শোন - ওনারা আমার গেস্ট। তুমি ওনাদের দেখাশুনা করবে। কখন কি লাগে না লাগে -দেখবে। আমি একটু পরে ওটিতে ঢুকবো। এই টাকাটা রাখো। ওনাদের জন্য নাস্তার ব্যাবস্থা করো। দুপুরে যদি আমি বিজি থাকি তাহলে ওনাদের লাঞ্চের ব্যাবস্থা করবে - ক্লিয়ার?" " জ্বি স্যার " " আচ্ছা এখন তাহলে তুমি যাও, আর শোন - যতোদুর সম্ভব রিচ ফুড এ্যাভোয়েড করবে।" "জ্বি স্যার।" রবিন ঘর থেকে বের হতেই রাতুল বললো -" আন্টি, আপনারা ওয়াস রুমে ঢুকে গোসল করে নেন - অনেক ধকল গেছে আপনাদের উপর দিয়ে।" ভদ্রমহিলা বললেন -" একটা কথা বলতাম বাবা।" " জ্বি বলেন।" " বলছিলাম বাবা, আমাদের কাছে তো আপাতত তেমন কোন পয়সাকড়ি নেই। যদি এই হারটা একটু বিক্রির ব্যাবস্থা করে দেন। আপনি অনেক করেছেন - এর প্রতিদান অবশ্যই আপনি পাবেন। আপনার মতো ছেলের মা হওয়া অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। যে মা আপনাকে পেটে ধরেছেন- একদিন তার পা ছুঁয়ে আমি সালাম করে আসবো। গতরাত থেকে মনে মনে ভাবছি - আমার জানপাখিটা সুস্হ হয়ে গেলে আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলবো - " হে আল্লাহ পাক - আমার জীবনের বাকি হায়াতটুকু তুমি এই ডাক্তার বাবাজির হায়াতের সাথে যোগ করে দাও। এমন মানুষের পৃথিবীতে হাজার বছর বেঁচে থাকা দরকার।" ভদ্রমহিলা রাতুলের হাত ধরে শিশুদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন। রাতুল বললো - "আপনি যাকে নিজের হায়াত দিতে চেয়ে সম্মানিত করলেন, সেই তাকেই আবার টাকা দিতে চেয়ে ছোট করছেন কেন? তারমানে আপনি আমাকে আপন ভাবতে পারছেন না, তাইতো?। ঠিক আছে - আজ থেকে আপনাকে আমি খালাম্মা বলে ডাকবো। এখন নিশ্চয় আমাকে আপনার পর মনে হচ্ছেনা। আপনার বোনের ছেলে যখন ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার - তখন আপনাকে এতো চিন্তা করতে হবে কেন? খালাম্মা শোনেন - আপনি খালুকে বলেন জমি বন্দক/বিক্রি - কিছুই করতে হবে না। ইরাবতীর জন্য যা করতে হয় - তার সবটাই আমি করবো। আমাকে নিচে গিয়ে ওটিতে ঢুকতে হবে। রবিন থাকলো, সে আপনাদের দেখাশুনা করবে। আর আমাকে তুমি করে বলবেন - আমি আপনার ছেলের বয়সী।" রাতুল ঘর থেকে বের হয়ে গেলে ফাহিমের দাদিমা ওর কাছে গিয়ে বললো - " এই লোকটাকে সারাজীবন মনে রাখবে ফাহিম। তুমি হয়তো কোনদিন তার কোন উপকারে আসবেনা , তবুও যদি জীবনে কোনদিন সামান্যতম সুযোগও পাও - তাহলে অবশ্যই তাঁর পাশে দাঁড়াবে। সব সময় মনে রাখবে - তিনি শুধু তোমার বোনের জীবন রক্ষা করেননি, কোন এক গভীর রাতে তিনি তোমার আম্মু ও দিদিমার সম্মান রক্ষা করেছিলেন।" ইরাবতীর অপারেশন শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ওর এম আর আই রিপোর্ট বেশ ভালো। মাথায় কোন ইনজুরি ধরা পড়েনি। ডান পা'টা হাটুর নিচে থেকে তিন টুকরো হয়ে গেছে । বাম পায়ের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভালো - সামান্য ভেঙ্গেছে, তবে হাড় আলাদা হয়ে যায়নি। ওটিতে ঢুকার আগে রাতুল ইরাবতীর মায়ের কাছে গিয়ে বললো - "আপনি রবিনের সাথে রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিন। অপারেশন হতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। এই সার্জারিটা আমার না, তবুও আমি ওটিতে ঢুকছি আপনাকে সাহস দেবার জন্য। আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। আমার নিজের মেয়ে হলে যা যা করতাম - আপনার মেয়ের জন্যও আমি ঠিক তাই তাই করবো। আপনি বোধ হয় দেখেছেন - গাড়ির ভিতরে সব সময় ওর একটা হাত ধরে বসেছিলাম আমি । ওকে প্রথম দেখেই আমার মনে হয়েছিলো -ও আমার অনেক দিনের চেনা। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষের সাথে ওর চেহারার অদ্ভুত রকমের মিল আছে। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন - যে গভীর মমতা নিয়ে আমি ওর হাতটা ধরেছিলাম - সেই মমত্ববোধের অপমান আমি হতে দেবোনা কোনদিন।" ইরাবতীর মায়ের মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারিত হলোনা। তিনি শুধু চোখের জলে বুঝিয়ে দিলেন - 'এই পৃথিবীটা আজ তার জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে।' অপারেশনের পরে ইরাবতীকে সি সি ইউতে রাখা হয়েছে। ছয় ঘণ্টার অবজারভেশন। তার ডান পায়ের ভিতরে একটা রড ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে , বছরখানিক পরে আর একবার অপারেশন করে ঐ রড বের করে ফেলতে হবে। ইরাবতীকে প্রথমে দেখে রাতুল যতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল - ততোটা ক্রিটিকাল সেচুয়েশান তাকে ফেস করতে হয়নি। কিছুদিন ইরাবতীকে হসপিটালে থাকতে হবে বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে কোন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে ক্যারি করতে হবেনা। সকাল এগারোটা। ইরাবতীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাকে ঘিরে বসে আছে তার আম্মু, দিদিমা এবং তার সারাক্ষণের খেলার সাথী ভাইয়া ফাহিম। তার একহাতে স্যালাইন - অন্য হাতে ব্লাড চলছে। সবকিছু যে এতো সহজে হয়ে যাবে - তা তারা স্বপ্নেও ভাবেননি। রাতুল নামের ছেলেটা হঠাৎ করে যেন দেবদূতের মতো উপস্থিত হলো ওদের জীবনে। এমন একটা ছেলে পাশে থাকলে জীবন কতো সহজ হয়ে যায়!! জীবনে কোন দুঃখ থাকেনা, বিড়ম্বনা থাকেনা, থাকেনা কোন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। এমন ছেলে কেন প্রতিটা ঘরে ঘরে জন্মায় না - তাহলে তো পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে যেতো!! ওটি শেষ করে রাতুল ফরহাদের সাথে চলে গেল ওর বাসায় । যদিও এখানে তার নিজের অফিস রুম আছে। কিন্তু ফরহাদ নাছোড় বান্দা - তাকে যেতেই হলো। যাবার আগে সে রবিনকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গেল এবং বলে গেল -ওদের কোন ব্যাপারে যেন কোন সমস্যা না হয়। একজন নার্স সারাক্ষণ ইরাবতীর দেখাশোনা করছে। খুব লক্ষী একটা মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা, তবে চেহারার মধ্যে আলাদা একটা মাধুর্য আছে - যার দিকে তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। বিকাল পাঁচটা। ইরাবতীর অবজারভেশন পিরিয়ড শেষ হয়েছে। তাকে কেবিনে নেবার প্রস্তুতি চলছে। ততক্ষণে রাতুল বিশ্রাম শেষে ফিরে এসেছে ওদের কাছে। ইরাবতীকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তবে গতরাতের সেই নিস্তেজ ভাব এখন আর নেই। রাতুল আসার সময় ইরাবতী আর ফাহিমের জন্য সুন্দর দুটো ড্রেস আর বড় দুই বক্স চকলেট কিনে এনেছে। ইরাবতীর ড্রেসটা একটু অন্য রকম। পায়জামাটা নরম কাপড়ের ডিভাইডারের মতো। দুইজন নার্স দক্ষতার সাথে পায়ের ব্যাণ্ডেজ আর ক্যাথেডার সামাল দিয়ে ওকে পায়জামাটা পরিয়ে দিলো। গায়ের গেঞ্জিটা সাদা - তার উপর লাল আর হলুদ রঙের গোলাপ ফুল ফুটে আছে। দেখে মনে হচ্ছে - একদল প্রজাপতি উড়ে এসে এক্ষুনি ওর জামার উপর বসে পড়বে। পায়ের ব্যাণ্ডেজ ডিভাইডার দিয়ে ঢাকা পড়ে গেছে। ইরাবতীর মা একফাঁকে ওর চুলগুলো বেণী করে দিয়েছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে - বহু দুরের এক রাজকন্যা অনেকদুর হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে খাটের উপর। রবিন চাবি দিয়ে ওদের কেবিনের দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকে সকলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো চারপাশে। কিছুক্ষণ আগে ঘরটা রং বেরঙের বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। সকালে দেখে যাওয়া ঘরের সাথে এই ঘরের কোন মিল নেই। ইরাবতীর খাটের মাথার কাছে বড় একটা ফুলের ডালা রাখা হয়েছে। সেই ফুলের গন্ধে সারা ঘর মৌ মৌ করছে। ওদের দাদিমা চিৎকার করে বলে উঠলেন - "দেখো দিদি ভাই, তোমার আংকেল তোমার ঘরটা কি সুন্দর করে সাজ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: