ছোটগল্প: এই বরষায় প্রথম দেখা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০২১ ০৬:৪২

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০২১ ০৬:৪২

ছবি সমসাময়িক
  আশরাফ হায়দার।। আজ পহেলা আষাঢ়। শুরু হলো বর্ষাকাল। সেই ভোর থেকে আকাশে বিস্তর ঘণকালো জলভরা মেঘে ছাওয়া। কখনো রোদ আবার কখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আবার কখনো ঝরঝর বৃষ্টি। নববর্ষার পানিতে মাছেরা প্রেমের খেলায় উন্মাদ। আরিফ বৃষ্টির মধ্যে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওনা দিলো। যথা সময়ে অফিসে পৌঁছে গেলো। রাতে কথা হয়েছিল ফেসবুক বন্ধু সেতুর সাথে। সকালে ওর সাথে দেখা করতে যাবে। সেতুর বাসা হলো খিলগাঁও। সেতু স্কুল শিক্ষিকা। দুই সন্তানের জননী। ছেলে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তবে সেতুকে দেখে মনে হলো না সে দুই সন্তানের জননী। কারন সেতুর শরীরের গঠন নববর্ষার ভরা নদীর মতো। দেখে মনে হলো বয়স হয়তো ত্রিশ বত্রিশ। সেতুর চেহারা শ্যামল মায়ায় জড়ানো। যেনো কোন এক গায়ের নববধূ। মুখে যেনো ভুবন মোহিনী হাসি। আর চুল গুলো তো কারুকার্যখচিত। এক কথায় বলা যায় রূপে গুনে এক মহীয়সী নারী। প্রথম দেখাতেই আরিফের চিনতে ভুল হয়নি। আটাশ বছর পর হলেও সেতুকে আরিফ চিন্তে পেরেছে। তাই সেতুর কাছে আরিফ জিজ্ঞেস করলো কোন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। সেতু বললো খিলগাঁও মডেল কলেজে। তখন আরিফ আরেক বার সেতুর দিকে ফিকফিক করে তাকিয়ে দেখলো। আরিফের সেই সেতু। এক সাথে কলেজে পড়তো। আরিফ যাকে মনে মনে ভালবেসেছিল। সেই ভালবাসা ছিল আরিফের একান্ত ব্যক্তিগত। আরিফ কখনো সেতুকে মনের সেই অব্যক্ত কথাটি বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি। সেতুর বাসায় আরিফ আজ মেহমান। সেতু আজও জানেনা আরিফ তাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভালবেসেছিল মনের মন্দিরে। শুরু হলো কথার চাষ‌‌। একপাশে বসলো সেতুর ছেলে মেয়ে ,আরেক পাশে বসলো সেতুর বড় ভাই রেজা। সেতুর বড় ভাই একজন প্রগতিশীল কবি‌। তাঁর কথায় বুঝা গেলো তিনি স্যেকুলার। তবে তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনে আরিফের মনে জাগ্রত হলো শ্রদ্ধাবোধ। আরিফ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সবসময় দুর্বল। তাই রেজা ভাইয়ের কথা আরিফ মনোযোগ সহকারে শুনতে ছিল। এরই মাঝে সেতুর ছেলে মেয়েদের সাথে আরিফের বেশ ভাব জমিয়ে উঠেছে। সেতুর ছেলে মেয়েরা লেখা পড়ায় খুব ভালো। কথার মাঝে মাঝে আরিফ সেতুর দিকে ফিকফিক করে তাকাচ্ছিল। আর তাকানোর কারণ হলো সেই সেতু আর এই সেতুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শুরু হলো আলাপ চারিতা। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি আর সাহিত্য। সাহিত্য নিয়ে বেশি আলাপ চারিতা হচ্ছে। কবিতার ছন্দ আর রূপ রস নিয়ে। আরিফের একটিই ইচ্ছা রেজা ভাইয়ের কাজ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনা। রেজা ভাই প্রচার বিমুখ মানুষ। এই পচনশীল রাজনীতির কারনে তিনি রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তাঁর মনের মাঝে একটা চাঁপা কান্নার বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে চলে গেছেন। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে নারাজ। কিন্তু আরিফ না ছোড়বান্দা সেই রেজা ভাইয়ের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনবেই তাই আরিফ ঘুরিয়ে ঘুরিয়েই মুক্তিযুদ্ধের কথা নিয়ে ব্যস্ত। যখন আলাপ চারিতা জমে উঠেছে ঠিক তখনই বাইরে আষাঢ় ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের উপর। এরই মাঝে সেতু কফি বানিয়ে আনলো। আরিফের অনেকদিন পর এই কফি খাওয়া তাই কফির স্বাদ ছিল অন্য রকম। আরো ভালো লাগার কারণ হলো আটাশ বছর পর সেই প্রেয়সীর হাতে বানানো কফি আরিফ আজ খাচ্ছে। কফি তো নয় যেনো আরিফ অমৃত খাচ্ছে। এই খাওয়ার মাঝে ছিল ভালবাসার গোপন ছোঁয়া। সেতুও একজন কবি। লেখার হাত বেশ ভাল। সাহিত্য বিশারদ চলছে। সেতুকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। মুখখানি যেনো শিল্পীর হাতে গড়া কারুকার্যময়। কথার মাঝে মাঝে সেতুর হাসিতে ঝরে পড়ছে ভোরের শিশির শব্দ। এতো কথার মাঝেও রেজা ভাই মুখ খুলছে না। কিন্তু আরিফ নাছোড়বান্দা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো শুনবেই। প্রথমে রেজা ভাই শুরু করলো রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি নিয়ে। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম নিয়ে। চার মূলনীতির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই মূলনীতি গুলো বাস্তবায়ন কি হয়েছে? কিন্তু কেনো হয়নি। এই সব বিষয় নিয়ে রেজা ভাই কথা বলছেন। তাঁর কথায় মনে হলো অনেক দিন পর তিনি মন খুলে কথা বলছেন। কথার মাঝে তিনি বলে ফেললেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নেননি। আস্তে আস্তে রেজা ভাই মনের অগোচরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে চলেছেন। এই স্মৃতিচারণে তিনি বললেন কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। কলকাতায় প্রথমে কার কার সাথে দেখা হয়েছিল। কি ভাবে তিনি ট্রেনিং নিয়ে ছিলেন। যুদ্ধের কলাকৌশল টুকটুক করে এক নাগাড়ে বলে ফেললেন। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি কি করলেন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বললেন। সেতুর ছেলে মেয়েরা রেজা ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার ভীষণ আগ্রহ ছেলে মেয়েদের। আরিফও মনযোগ সহকারে শুনতে ছিল। রেজা ভাইয়ের স্মৃতিচারণে লুকায়িত ছিল মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইনফরমেশন। আরিফ মাঝে মাঝে সেতুর দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে সেই সেতু এই সেতু। আটাশ বছর আগে যেমন দেখেছিল এখনও তেমনই আছে। কেবল কোল আলো করে দু'টি সন্তানের মা হয়েছে। হয়তো কয়েক বছর পর নানী দাদী হবে। সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। তেমনই সেতু বা আরিফের বেলায় হয়নি। সময় অনবরত পরিবর্তনশীল। তেমনই রেজা ভাইয়ের ও বেলায় তাই ঘটেছে। যুদ্ধ শেষ হলো দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর পার হতে চললো। রেজা ভাই, রেজা ভাই থেকে গেলেন। বিয়ে আর করা হলো না তাঁর। রেজা ভাইয়ের মত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আছেন বিয়ে করেননি। দেশের কথা ভেবে দেশের মানুষের কথা ভেবে সংসার করেননি তাঁরা। তখন ও আষাঢ়ের বৃষ্টি টুপটাপ করে ঝরে যাচ্ছে সবুজের বুকে। এরই মাঝে আরিফ মনোযোগ সহকারে রেজা ভাইয়ের কথা শুনতে ছিল। এবার কথার ধরন বদলে গেলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে শুরু হলো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু,বাঘা যতীন,রাসবিহারী বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ,মোওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাস্টার সূর্য সেন,হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর,ভগৎসিং, প্রীতিলতা,বিনয় বাদল দীনেশ সহ অসংখ্য শহীদদের নাম। যারা জীবন দিয়ে,রক্ত দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন কর


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: