শহিদুজ্জামান মিলন।।

১৯৫৪ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সাবেক আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী শহীদ মসিউর রহমানের নির্বাচনী প্রচারে আসেন। দীর্ঘ সাংগঠনিক ও নির্বাচনী আলাপ শেষে সিদ্ধান্ত হল মশিউর রহমানের এলাকায় জনসভা করে (বৃহত্তর যশোর) জেলার নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করবেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে প্রার্থী ছিলেন শহীদ মসিয়ূর রহমান। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তখনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে শেখ সাহেব, না হলে মুজিব ভাই বলে পরিচিত। সেকালের বাঙ্গালীদের প্রিয় মুজিব ভাই যশোরের অসাধাণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতা মসিয়ূর রহমানকে আপন বড় ভাই’র মতো শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সে সময় ঝিকরগাছা থানায় দুটি জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেন। এর একটি থানার উত্তর এলাকায়, অপরটি দক্ষিণে। যুক্তফ্রন্টের যশোরের ঝিকরগাছার দুইটি জনসভা ছিল এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে।
উত্তর এলাকার জনসভার স্থান বঙ্গবন্ধু নিজেই নির্বাচন করে দিয়েছিলেন। একটি উত্তরে চৌগাছার সিংঝুলি ইউনিয়নের মুক্তারপুর গ্রামে অপরটি দক্ষিণে ঝিকরগাছার নায়ড়ায়। সে মোতাবেক প্রস্তুতি। খবর দিলেন ঝিকরগাছা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুর বকসী হাজিকে (নুর বকসী হাজির বাড়ি ছিল চৌগাছার উজিরপুর গ্রামে)। জনসভার স্থান নির্ধারণ করলেন চৌগাছার মুক্তারপুর প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। নুর বকসী হাজি খবর দিলেন অনুজ আওয়ামী লীগের তৎকালীন চৌগাছার সিংহঝুলি ইউনিয়নের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও অবিভক্ত চৌগাছা-ঝিকরগাছা থানার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তারপুর গ্রামের সামসুজ্জোহা ভাটাই বিশ্বাসকে। সদা হৃদ্যতায়ভরা, এলাকায় জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ভাটাই বিশ্বাস খবর পেয়ে আপ্যায়ন এবং তাদের বিশ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। নিজ পুকুরের ১২ সের ওজনের রুই, কাতলা ধরলেন এবং ২৭ সের ওজনের একটি খাশি জবাই করলেন।
তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী মশিউর রহমানের সাথে করে যশোর থেকে লক্কর-ঝক্কর বাসে চেপে সোজা ১৪ মাইল পশ্চিমে শহীদ মশিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি সিংহঝুলী আসলেন বঙ্গবন্ধু। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ঝিকরগাছার অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান। বঙ্গবন্ধু এবং মশিউর রহমান দুইটা বাইসাইকেল যোগে উপস্থিত হলেন মুক্তারপুর ভাটাই বিশ্বাসের বাড়িতে। সফর সঙ্গী ছিলেন অ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন, অ্যাডভোকেট রওশন আলী, তৎকালীন সাবাশ চেয়ারম্যান নামে খ্যাত আবুল ইসলাম এবং নূর বকসী হাজি।
শেখ মুজিব ভাই (তখনকার সময় শেখ মুজিব সাহেব না হয় মুজিব ভাই বলে ডাকত) আসছেন, এলাকায় যেন হিল্লোল বইছে। শত শত বাইসাইকেল, অগণিত গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি এবং কপোতাক্ষে নৌকা যোগে মুক্তারপুর স্কুল মাঠে জমায়েত হন কৃষক ছাত্র জনতা। জনতার ঢল উপচে পড়া ভিড়ে নিঝুম নিভৃত মুক্তারপুর মুহূর্তে প্রণচঞ্চলতায় ভরে উঠল।
খাওয়া শেষে স্কুল মাঠের বক্তৃতা মঞ্চে চলে গেলেন উভয় নেতা। স্কুল মাঠ কপোতাক্ষ নদের পাড়। জনসভার সংবাদে চৌগাছা, ঝিকরগাছা এবং শার্শা এলাকায় বাঁধভাঙ্গা জোয়ার চলছে। যুক্তফ্রন্টের ঐ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন ঝিকরগাছা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহা ভাটাই বিশ্বাস। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু তার স্বভাব সুলভভঙ্গীতে বাংলার জনগণের হৃদয়ের পুঞ্জীভূত বেদনা, শিক্ষা, অর্থনীতি, কৃষি সংস্কৃতি, পাকিস্তানি হায়েনাদের শোষণ-বঞ্চনার গভীর দর্শন উপস্থাপন করেন ২১ দফার আলোকে।
সাতক্ষীরার সুলতানপুরের মরহুম খোন্দকার আব্দুল বাতেন ( খ্যাতনামা কলামিস্ট আব্দুল গফফার চৌধুরীর ঘনিষ্ট বন্ধু) মিয়ার বাড়িতে রাত যাপন করে বঙ্গবন্ধু সাতক্ষীরা-যশোর ইটের রাস্তায় চলাচলকারী লক্কড়মার্কা বাসে এসে নেমেছিলেন শার্শার বাগআঁচড়া বাজারে। সেখান থেকে সাইকেলে চেপে দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সভা করেন আজকের নায়ড়ার বাজারে। নায়ড়া গ্রামের জনসভা পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধুর ‘সাবাশ চেয়াম্যান’ নামে খ্যাত আবুল ইসলাম।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোরের অজোপাড়াগাঁ নায়ড়া গ্রামে সফরে আসেন। ১৯৫৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা ১১টায় যশোর সাতক্ষীরা মহাসড়কের শার্শা উপজেলার নীলকান্ত মোড়ে পৌছান বঙ্গবন্ধু, সাথে ছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মশিউর রহমান। কাঁচা রাস্তা তাই বঙ্গবন্ধু সামটা গ্রামে তার বহনকারি প্রাইভেট কার রেখে গরুর গাড়িতে উঠেন। দৈনিক সংবাদপত্র প্রেস ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নায়ড়া গ্রামের খোন্দকার বজলুর রহমান নীলকান্ত মোড় থেকে গরুরগাড়িতে করে অতিথিদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন নায়ড়ায়। এখানে পৌছে বঙ্গবন্ধু দিঘিতে ওজু করে হযরত শাহ সুফি সুলাইমান (র) এর মাজার জিয়ারত করেন। জিয়ারত সেরে মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করেন। দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন খোন্দকার বজলুর রহমান তার বাড়িতে। পরে বিকেলে নায়ড়া বাজারে তিনি এক জনসভায় বক্তব্য রাখেন। খোন্দকার বজলুর রহমান বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।
১৯৫৪ সালে একই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মণিরামপুরের রাজগঞ্জ আসেন।তিনি কাশিপুর নিসার আলী মুন্সীর বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করেন এবং সাইকেল চালিয়ে রাজগঞ্জ বাজারে আসেন । সেখানে তিনি টিনের চোঙ ব্যবহার করে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী গৌরীপুরের ডাঃআহাদ আলীর নির্বাচনী প্রচারণামূলক জনসভায় ভাষণ দেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: