
হুমায়ূন কবীর।।
আজ বুধবার। মতি বিশ্বাস এই একদিন মাস্টার সেজে বসে। এইদিন তার দোকানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। দুপুর ১২ টার পর সে বেকার। সময় আর কাটে না। সন্ধ্যা হওয়ার সাথেসাথে ভাইপো দুটোকে পড়াতে বসে। এক সপ্তার সমস্ত পড়া সে একদিনে ধরে।পড়া কিছু হয়, কিছু হয় না। তাই শাস্তি এইদিন নিয়তির মতো হয়েগেছে। মতি বিশ্বাস বিভিন্ন শাস্তি প্রয়োগ করে, ভাইপো দুটো ছটফট করে।
এখন মতি বিশ্বাসের হাতে একটা রঙিন পেন্সিল,মুখে মিটিমিটি নিষ্ঠুর হাসি। পেন্সিলটা সে বিশেষ কৌশলে ঘুরাচ্ছে আর প্রাইমারির দুই ছাত্র পড়াচ্ছে। ঘূর্ণায়মান পেন্সিলটির দিকে মাঝেমাঝে আতংকিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দুই ছাত্র – কাদের এবং আরিফ।তাদের আতংকের কারণ, পেন্সিলটি যেকোনো সময় বাঁশকলে পরিণত হতেপারে। ওটা বাঁশকলে পরিণত হলে সেটা হবে ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক।আঙুলের হাড়গোড়ও ভেঙে যেতে পারে।
বাঁশকল সাধারণত গ্রামে গরুচোরদের উপর প্রয়োগ করাহয়। স্বীকারোক্তি আদায় করার এটা একটা সহজ কৌশল।জাদুর মতো কাজ করে কলটা। এটা তৈরি করাও খুব সহজ। গ্রামে তো বাঁশের অভাব নেই। গরুচোর ধরাপড়লে বাঁশকলে শুধু ঢোকানোর দরকার। সত্যমিথ্যা সব স্বীকার করে দেবে।
কাদের, আরিফ এরা তো গরুচোর না। পড়াচোর। চোর তো চোরই। তবু পড়াচোর হিসেবে শাস্তি কম। সেই হিসেবে এদের পেন্সিল কলে ফেলা যায়। দুই আঙুলের মাঝে পেন্সিল ঢুকিয়ে আঙুলের মাথা দুটো চেপে ধরো। পেন্সিলটা আস্তে-ধীরে ঘুরাও – ছাত্র কাবু। লাঠি দিয়ে মারতে গেলে খাটনি আছে। পেন্সিল কল খুবই আরামদায়ক। খাটুনি কম, শাস্তি বেশি। মতি মাস্টার মেধাবী লোক, সে খাটুনি করবে কেনো? সে সহজ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। মেধাবীরা খাটুনি করে না।
মতি বিশ্বাসের হাসি দেখে আরিফ বললো, “পানি খাবো। ”টেবিলের একপাশে জগ-গ্লাস রাখা আছে। কাদের পানি ঢেলে দিতে যাচ্ছিলো। মতি মাস্টার লাল চোখ দুটো আরও লাল করে,মোটা করে কাদেরের দিকে তাকালো। কাদের থেমে যেয়ে আরও মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলো, “ পাকা জামের শাখায় উঠে রঙিন করি মুখ। ”
আরিফ দুলে দুলে পড়ছে, “ পাকাই আমের, পাকাই জামের। ”মতি মাস্টার পেন্সিল দিয়ে আরিফকে বাঁশকল দিতে যাচ্ছিলো, কী মনে করে মৃদু হেসে থামলো। নিজহাতে পানি ঢেলে আরিফের মুখে ধরলো। আরিফ প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে সেই পানি করলার জুসের মতো অতিকষ্টে কয়েক ঢোক গিলতে পারলো। তারপর চোখমুখ বিকৃত করে অতিকষ্টে অতিমনোযোগ দিয়ে দুলে দুলে পড়তে লাগলো, “পাকাই আমের,পাকাই জামের। ”
মতি মাস্টারও আরিফের সাথে দুলেদুলে খুশি মনে মৃদু হেসে নিচের মোটা ঠোঁট ঝুলিয়ে স্মৃতি রোন্থন করতে লাগলো।ছয়মাসেও আরিফের - পাকাই আমের, পাকাই জামের - সংশোধন হলো না। সে একবারের জন্যও পড়তে পারলো না –পাকা জামের শাখায় উঠে রঙিন করি মুখ। এক্ষেত্রে মতি মাস্টারের পেন্সিল কলও ব্যর্থ।রাগে, দুঃখে একদিন না পেরে সে আরিফকে মাথার উপর তুলে আছাড় মেরেছিলো। তাতেও কাজ হলো না।
আরিফ অনাবরত পড়ছে, “পাকাই আমের পাকাই জামের। ”মতি মাস্টার চোখ বুজে গবেষণা করছে, পেন্সিল কলের চেয়েও আরও শাস্তিদায়ক কোনো কার্যকরী কল আবিষ্কার করা যায় কিনা। তার নিচের মোটা ঠোঁটে লেপ্টে আছে একচিলতে নিষ্ঠুর হাসি।
তার দৃঢ় বিশ্বাস আরও ভয়ংকর অভিনব কল সে আবিষ্কার করতে পারবেই এবং মাস্টার সমাজ তার অবদানের ঋণ চিরকাল কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবে। এই মিঠাইমনি গ্রামে কেনো, আশেপাশের দশ গ্রামে তার মতো মেধাবী ছাত্র আগেও কখনো ছিলো না,এখনো নেই, ভবিষ্যতে জন্মাবে কিনা সন্দেহ। অতএব সে না পারলে আর কে পারবে?তাকে পারতেই হবে।
মেডিকেলে ভর্তি হয়ে, একবছর পড়ে, পড়া বাদ দিয়ে সে গ্রামে এসে দোকানদারি করছে। সে নিজে অভিনব লোক। তার মাথা থেকে তো অভিনব প্রযুক্তি বের হবে। হতেই হবে। রান্নাঘর থেকে মা এসে দাড়িয়েছেন। “মতি, পড়ানো শেষ হলো?খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ”
মায়ের কথা আদেশ। মতি মা’কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। সে বুঝলো, মা আর পড়াতে দেবে না। মা রান্নাঘর থেকেই দেখেছে মতির পেন্সিল ঘোরানো। ঘোরানো দেখে তিনি আতঙ্কে ছিলেন। তিনিও নাতি দুটোকে বাচানোর পথ খুজছিলেন। মতিকে চোখ বুজতে দেখে তিনি বুঝে ফেলেছেন, সে আরও ভয়ংকর কোনো পদ্ধতির কথা ভাবছে।
মায়ের কথায় মতি বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিলো। বলেদিলো, “ কাদের, তোকে দায়িত্ব দিলাম, আগামি বুধবার যেনো আরিফ সঠিক উচ্চারণে পড়া দেয়, নাহলে ওর তো শাস্তি দেবোই, তোকেও দেবো। যা। ”
ছুটি হয়েও হলো না। আরিফ, কাদের হাসিমুখে ভাত খেতে যাচ্ছিলো।তাদের মুখ আবার চিন্তায় কালো হয়ে গেলো। আরিফ, কাদের খেতে বসেছে ডাইনিং টেবিলে। তাদের অপজিটে বসেছে মতি বিশ্বাস। মতি বিশ্বাস ওদের আপন বড় চাচা। এই লোকটার সামনে ওরা পানিও খেতে পারে না। ভাত গিলতে গেলে মনেহয় ইটের ছোটো ছোটো টুকরা। কিন্তু কিছু করার নেই। সপ্তাহের একটাদিন এই অত্যাচার তাদের সহ্য করতেই হয়।
মতির মা তিনকেজি ওজনের কাতলামাছ দিয়ে লাউ রেধেছেন। মাথাটা একটা প্লেটে করে মতির সামনে রাখলেন। মতি সেটা কাদেরকে দিয়ে বললেন, “এটা তুই খা। এটা তোর পুরস্কার। আগামী বুধবার যদি আরিফ সঠিক উচ্চারণে পড়া দিতে পারে তাহলে দুজনকেই খাসির মাথা দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়াবো। আর না পারলে -----। ”
কথা অসমাপ্ত রেখে সে খাবার প্লেট নিয়ে নিজের ঘরে চলেগেলো। বাড়িটা ডাবল ফ্ল্যাটের। ডাইনিং একটা। ডাইনিং শেষে ছাদে যাওয়ার সিড়ি শুরু। ডাইনিং এর দুইপাশে দুই ফ্ল্যাট। ডাইনিং রুমই বিল্ডিংটার প্রবেশপথ। তিনটা, তিনটা মোট ছয়টা রুম।একটাতে কাদেরের মা-বাপ,একটাতে আরিফের মা-বাপ, একটাতে দাদা -দাদী, একটা তে কাদের-আরিফ আর একটাতে বড় চাচা স্বয়ং অবিবাহিত মতি বিশ্বাস থাকে। একটা রুম আত্মীয় স্বজনের জন্য খালি পড়ে থাকে। যৌথ এই পরিবারটিতে মতি বিশ্বাসের কথাই শেষকথা। কাজেই তার আগামী বুধবারের আল্টিমেটাম কার্যকরী হবে। বাচ্চা দুটোর কী পরিণত হয়, শাস্তির অভিনব কী কল মতি আবিস্কার করে সেটাই এখন পুরো পরিবারের চিন্তার বিষয়।
দেখতে দেখতে সপ্তা শেষ। সেদিন সকালবেলা কাদের আর আরিফ স্কুলের পথে বেরিয়ে ওদের ক্লাসের ওলিয়ারকে ডাকতে গেলো।ওলিয়ারদের বাড়ির পাশে সাইদ লাঙল দিয়ে জমি চাষ করছে। ওদের দেখে সাইদ বিশ্রী রকম একটা হাসি হাসলো। শিং মাছের মতো কালো কুচকুচে সাইদ লোকটা। তার দাঁতগুলো চকচকে ছুরির মতো ধবধবে সাদা। সেই ছুরি দেঁতো সাইদের রহস্যময় হাসির সামনে দিয়েই ওরা ওলিয়ারের বাড়ির বেড়ার কাছে পৌঁছে গেলো।
ওলিয়ারদের বাড়িটা কচার বেড়ায় ঘেরা। বেড়ার বাইরে বইয়ের ব্যাগ দুটো রেখে ওরা বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো। ওলিয়ার উঠানে রোদে বসে নারকেল তেল মাখছে ।ফাল্গুনের হাল্কা শীতেও তেল জমে আছে। ওলিয়ার তেলের বোতল রোদে রেখেছে তেল গলানোর জন্য। তেল গলছে না। একটা চিকন পাটকাঠি বোতলে ঢুকিয়ে একদলা তেল বের করে হাতের তালুতে রেখে ঘষছে। খসখস শব্দ হচ্ছে। ওদের দেখে সে তাড়াতাড়ি তেল মাখা শেষ করলো। তারপর জামাকাপড় পরে ভাত খেতে গেলো। কাদের বললো, “আরিফ, চল।এর জন্য দাড়িয়ে থাকলে স্কুলে দেরি হয়ে যাবে। ”
ওরা বাইরে বেরিয়ে দেখলো বইয়ের ব্যাগ দুটো নেই। তন্নতন্ন করে খুজেও কোথাও পেলো না। শেষে সাইদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই,আমাদের ব্যাগ দেখেছেন? ”সাইদ রহস্যময় হাসি হেসে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, “ না।”
ওরা বেড়ার কাছে এসে হন্যে হয়ে আবার খুজলো। না।কোথাও ব্যাগ নেই। এখন উপায়? বাড়ি যেয়ে বললে কপালে মাইর ছাড়া কিছুই জুটবে না। স্কুলে স্যারের সাথে বললে শুধু শাস্তিই জুটবে। বই ছাড়া স্কুলেই বা যাবে কীভাবে? ভয়ে আরিফ কেঁদেই ফেললো।আরিফের কান্না দেখে কাদেরের ও কান্না এলো।
কাঁদতে কাঁদতে, চোখ মুছতে মুছতে ওরা প্রায় শুকনা নদীটির বাঁশের সাঁকো পার হয়ে গেলো। টার্গেট ফুফু বাড়ি। মিঠাইমনি গ্রাম থেকে আলিপুর ফুফু বাড়ি ১৫ কিলোমিটার পথ। অধিকাংশ রাস্তা কাঁচা। হাইওয়ে দিয়ে ঘুরে গেলে সম্পূর্ণ পিচ রাস্তা। তবে পথ অনেক বেশি। ওরা যাচ্ছে সোজাসুজি- হেটে।
প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেটে ওরা মথুরাপুর মাঠের ভিতর এলো।মথুরাপুর মাঠের ভিতর রাস্তার দুই পাশে খেজুর গাছ আর খেজুর গাছ। সব গাছেই মাটির ভাড় পেতে রেখেছে। রাতের রস গাছিরা খুব ভোরে নামিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সারাদিনও রস গলে তাই অন্য একটা ভাড় পেতে রেখে যায়।
কাদের একটু খাদক টাইপের ছেলে। চারপাশে রস দেখে তার রস খেতে ইচ্ছে করলো। দুই কিলোমিটার পথ হেটে তার একটু খিদেও লেগেছে। সে আরিফকে বললো, “এই, রস খাবি?”লেখাপড়া এবং খাওয়ার ব্যপারে আরিফ খুব উদাসীন। সে বললো, “না খাবো না। ”
কাদের একটা পাটকাঠি কুড়িয়ে তরতর করে গাছে উঠেগেলো। এইসময় গাছের মালিক পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। সে বললো, “এই মনি, তোদের বাড়ি কোথায়? ”ভিত আরিফ কোনো উত্তর দিলো না। কাদের গাছের মাথা থেকে উত্তর করলো, “জি, মিঠাইমনি।”
লোকটা ছেলে দুটোকে একনজর দেখলো – ভালো শার্ট -প্যান্ট পরা।পায়ে দামি কেডস। সে বুঝলো এরা ধনী পরিবারের সন্তান। বললো, “রস খাবি?খা খা। ”হাসতে হাসতে সে মাঠে নিজের কাজে চলেগেলো। কাদের রস খেয়ে নিচে নেমে এলে আরিফ বললো, “আমার জন্য আনলি না?”
“ তুই যে বললি, খাবি না।”
আরিফ কথার উত্তর না দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ অন্ধকার করে হাটা শুরু করলো। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় বর্ষার সময় কাঁদা, শুকনো মৌসুমে ধুলা। ওদের কেডস, প্যান্টের নিচের অংশ ধুলায় মাখামাখি অবস্থা।
কাদের বললো, “এই প্যান্টের কী অবস্থা দেখেছিস?”
আরিফ নিজের এবং কাদেরের প্যান্টের দিকে তাকিয়ে বললো, “পানি খাবো। ”
“পানি খাবি সামনে চল। ঐ দেখ রাস্তার পাশে একটা স্যালো মেশিন চলছে। ”
এখন ইরিধানের সিজন।রাস্তার দুই পাশে সমস্ত মাঠে ইরিধান আর ইরিধান। ধানে পানি দেওয়ার জন্য মাঠে অনেক পানি তোলা ম্যাশিন চালানো আছে। কাছেই একটা ম্যাশিন চলছে। কিন্তু সেটা রাস্তার পাশে না। রাস্তা থেকে কয়েকটি জমির পর।যেতে হলে আইলের উপর দিয়ে যেতে হবে ।আইলগুলো অত্যন্ত সরু আর নরম। পা পিছলে পানি-কাঁদার ভিতর পড়ে যাওয়ার ৯৯{42d7c02d75ed8ad2566d5e0848d1e673e35e1703bc782a9c186d8d8d27235b37} সম্ভাবনা আছে। কয়েকটি বক আইলের উপর দিয়ে হেটে হেটে পোকা ধরে খাচ্ছে।
আরিফ বললো,” আমি এখন থেকেই পানি খাবো।”
কাদের, “ যেতে পারবি না। পড়ে যাবি। বক হলে যেতে পারতিস। তুই বক হ। ”আরিফ, “বক হতে পারলে ভালোই হতো রে। পড়ার জন্য মাইর খাওয়া লাগতো না। সারাদিন উড়ে বেড়াতাম ইচ্ছে মতো।”
কাদের, “মানুষ ফাঁদ পেতে তোকে ধরে খেয়ে ফেলতো। তখন এতো পথ আমি একা-একা হাটতাম কী করে? ফুপু বাড়ি যেতাম কীভাবে? বাড়িফিরে মাইর তো আমার একাই খাওয়া লাগতো। ”
আরিফ, “তুই তো লেখাপড়ায় ভালো। তুই মাইর খাওয়ার চিন্তা করছিস কেন? ”
কাদের, “ এতো পড়তে কার ভালো লাগে বল?যদি মন্ত্র জানতাম তাহলে একটা টিয়া হয়ে উড়ে বেড়াতাম। বাড়ি যেতাম না। ”
আরিফ, “টিয়া হলে মানুষ তোকে ধরে খাচায় ভরে রাখতো। ”
শেষমেশ ওরা বকও হলো না,টিয়াও হলো না। হাটতে হাটতে ওরা রাস্তার পাশে ম্যাশিনের কাছে চলে এলো।আরিফ ম্যাশিনের মুখে মুখ লাগিয়ে পেটভরে পানি খেয়ে একটা তৃপ্তির হাসি হাসলো। কিছুদূর এগিয়ে দেখলো রাস্তার পাশে বাবলাগাছটার নিচে বসে একটা লোক।লোকটা মোটাতাজা। একটা হাত মাটিতে ঠেকানো।অন্য হাতটা মুখে। সে বিড়ি টানছে।তার চোখ দুটো লাল টকটকে, জবাফুলের মতো। ডাকাত ডাকাত চেহারা। সামনে একটা চকচকে দা। অবস্থা দেখে ভয়ে ওরা দাড়িয়ে পড়লো।
এখন প্রায়ই দেখাযায়, বাচ্চাদের ধরে ভিতর থেকে হার্ট, কিডনি বের করে নিয়ে লাশ ফেলে দেয়। এই ফাঁকা মাঠে লোকটা যদি ওদের ধরে পাশের বনের ভিতর টেনে নিয়ে হত্যা করে দেখার কেউ নেই।
দুইজন দাড়িয়ে কিছুক্ষণ যুক্তি করলো।তারপর ঝেড়ে দৌড় লাগালো। লোকটা এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু একটু অবাক হলো। ছিলিমপুর খাল পাড়ে এসে আরিফ আর থাকতে পারলো না। খালের পাড়ে হড়হড় করে বমি করে ফেললো। কাদের খালে নেমে নারকেলের মালায় ভরে পানি এনে আরিফের মাথায় ঢাললো।
দুপুর পার করে ওরা যখন ফুপুর বাড়ির কাছাকাছি পৌছালো তখন ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ। হঠাৎ আরিফ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আরিফ কেঁদে বললো, “আমি বাড়ি যাবো। আমার মা মনেহয় কান্নাকাটি করছে। আমার খুব মায়া করছে। ”বলতে বলতে সে একটু কেঁদেও ফেললো।
কাদেরের তখন এতো ক্ষুধা লেগেছে যে মনে হচ্ছে, একটা আস্ত ছাগল গিলে খেতে পারলে ভালোহতো। কিন্তু হঠাৎ তার ক্ষুধাও কোথায় হারিয়ে গেলো।আরিফের কান্না তাকে সংক্রামিত করে ফেললো।তার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে যেয়ে নিজেরও বুক ভেঙে কান্না আসতে লাগলো। বুকের ভিতর ফেনিয়ে ওঠা কান্নার ঢেউ কণ্ঠকে চেপে ধরলো। কাদের ধরা গলায় বললো, “আমার মা’ও মনে হয় কাঁদছে রে। ”
আর মাত্র এক কিলোমিটার পথ গেলেই ফুপু বাড়ি। ফুপু বাড়ি গেলে খাবার, নিরাপত্তা দুটোই আছে। ফুপুদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। গ্রামের ভিতর বিশাল বাড়ি, ফলের বাগান। বাড়ির পূর্বপাশে বড় পুকুর ভর্তি মাছ আর মাছ। সবচেয়ে বড় কথা সেখানে পড়ালেখা নিয়ে কোনো ঝামেলায় নেই। কিছু না হোক একসপ্তা তো নিশ্চিত নির্ভাবনায় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এখন বাড়ি ফিরে গেলে তো বিপদের শেষ নেই। বই হারিয়ে ফেলার শাস্তি আছে। আরিফের উচ্চারণ ঠিক হয়নি, সে শাস্তি আছে।এখনই দুপুর পার হয়েগেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে যাবে।ক্ষুধার্ত - ক্লান্ত শরীরে আবার ১৪ কিলোমিটার পথ পায়ে হাটা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যাবে। আজ স্কুল কামাই গেছে কাল গেলে এর ফল ভোগ করতে হবে। আর স্কুলে যাবেই বা কী করে বই তো হারিয়ে গেছে। সবকিছু ভেবে কষ্টে ওরা আরও ক্লান্ত হয়ে পড়লো।কিন্তু মা কাঁদছে এই ভাবনার মায়ার প্রবল স্রোতে ভেসে গেলো পৃথিবীর সব ভয় ।ওরা ঘুরে বাড়ির পথে হাটা ধরলো।
রাস্তার পাশে আমগাছ ওয়ালা বাড়িতে মনেহয় মাছ ভাজি করছে। সেই সেন্ট চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।মাছ ভাজার সেন্টে থিতিয়ে যাওয়া খিদে চনচন করে মাথায় উঠে গেলো। আরিফ বললো, “ওহ্, এটাই যদি ফুপু বাড়ি হতো!”
কাদের একটু রেগেই বললো, “এই, হাট তো। ”
হাটতে যতো কষ্ট হবে ভেবেছিলো ততো কষ্ট হচ্ছে না। বরং বাড়ি ফেরার পথ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফেরার আনন্দের ঢেউ ওদের মন-প্রাণ ফুরফুরে করে তুলছে।
মাজদিয়া গ্রাম পার হলে সেই মাঠ।যে মাঠে সেই লোকটা দা নিয়ে বসে আছে। ভাবতেই গা শিউরে উঠলো।তখন না হয় দৌড়ে বাঁচা গিয়েছিলো এইবার যদি সে দৌড়ে ধরে ফেলে?
তখন মাজদিয়া হাইস্কুল ছুটি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা রাস্তা দিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটছে। ধুলা উড়ছে। আরিফ, কাদের এরাও স্কুলের পথে এইভাবে ধুলা উড়ায়। ওরাও ওদের সাথে ধুলা উড়াতে উড়াতে মাঠ পার হয়েগেলো। কোথাও সে দা ওয়ালা লোকটা নেই। যাক,বাঁচাগেলো।
ওরা বাড়ি পৌছানোর আগেই সব প্রাইমারি স্কুল ছুটি হয়েগেছে। ছেলেমেয়েরা সব বাড়ি চলেগেছে। এখন বাড়ি ঢুকে ওরা কী কৈফিয়ত দেবে?
ওদের বাড়িটা রাস্তার পাশেই। বাড়ির পেছনটা রাস্তার দিকে। রাস্তার থেকে নেমে পুকুরপাড়ের কোনায় পেঁপে গাছের নিচে ওরা চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো। বাড়ির ভিতর থেকে বড় চাচা মতি বিশ্বাসের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আজ বুধবার। আজ তার দোকান সাপ্তাহিক বন্ধ। এ তো আজ আর বাড়ি থেকে বের হবে না। ওর সামনে দিয়ে এখন বাড়ি ঢোকা আর বাঘের সামনে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যাওয়া একই কথা। কঠিন শাস্তি অবধারিত।
আরিফের মা এইসময় পুকুরের দিকে যাচ্ছিলো চুলার ছাই ফেলার জন্য। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলো, আরিফ আর কাদের ঘরের দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। থাকলো তার ছাই ফেলানো। পাত্রটা কোনোরকম মাটিতে রেখে দৌড়ে এলো। আরিফ মাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানিতে শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেললো ।মতি বিশ্বাসের ভয়ে শব্দ করে কাঁদতেও পারলো না। মা ছেলের চোখে,মুখে, মাথায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে ফেললো।
কাদের তখন মনখারাপ করে,মুখ অন্ধকার করে একপাশে চুপচাপ দাড়িয়ে তার নিজের মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কষ্টে তারও বুক ফেটে যাচ্ছে।কিন্তু সে কাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে? আরিফের মা কাদেরের দিকে তাকিয়ে, তার অন্ধকার মুখ দেখে বুঝে ফেললো আসল অপরাধী কাদের। ঐ কদেরই তার সহজসরল ছেলেটাকে এইভাবে শেষ করে এনেছে। সে কাদেরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, “কোথায় ছিলিরে হারামজাদা সারাদিন?”
কাদের সে কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ কাঁদতে লাগলো। এরপর একে একে কাদেরের মা এলো,দাদী এলো। শেষে দাদা এসে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো, “এই, কোথায় ছিলিরে তোরা সারাদিন? ”বাড়ির বাইরে জোরে কথাবার্তা শুনে মতি বিশ্বাস বেরিয়ে আসলো। তার হাতে একটা ছুরি।
মতির হাতে ছুরি দেখে সবাই তটস্থ হয়েগেলো। তাকে বিশ্বাস নেই। কী করে ফেলবে তার ঠিক নেই।
বাড়ির ভিতর টেনে এনে জেরায় জেরায় জর্জরিত করে ফেললো। ওরাও বাধ্য হয়ে সারাদিনের সব স্বীকার করতে বাধ্য হলো। সব শুনে সে হুকুম করলো, “লেবু আর লবণ নিয়ে এসো। আমি এদের চোখ তুলে চোখের গর্তে লেবু আর লবণ দেবো। ”
কথাগুলো বলে মতি তৃপ্তির হাসি হাসলো। কাদের আর আরিফ বুঝলো বড় চাচা এই শাস্তি আবিষ্কার করেছে। শেষবারের মতো তারা দুই চোখে হাত বুলিয়ে মনের সুখে কেঁদে নিলো।
লবণ এলো,লেবু এলো। মতি বিশ্বাস লেবু কাটতে কাটতে বললো, “এই, হাতমুখ ধুয়ে আয়। ”
তারা হাতমুখ ধুয়ে মতি বিশ্বাসের সামনে এসে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকলো। চোখ নিজে নিজেই তখন নিজের অস্তিত্ব পরীক্ষা করার জন্য বারবার মিটকি মারতে লাগলো।
মতি তাদের চেয়ার টেনে বসতে বললো, বিসমিল্লাহ পড়ে পানি খেয়ে নিতে বললো। তারা দেখলো ডাইনিং টেবিলে দুটো কাচের গ্লাসে ঘোলাপানি ভরা। কিছুই করার নেই। বিসমিল্লাহ বলে তারা সেই ঘোলাপানি খেতেই বাধ্য হলো। তারপর তাদের শরীর মন শান্তিতে ভরে গেলো। ওরা বুঝলো ঐ ঘোলাপানি তো আসলে শরবত।
বড় চাচা তাদের নিজহাতে শরবত বানিয়ে খাওয়ালো? আজ চোখ তুলবেন বলেই কি এতো যত্ন করছেন?
দাদা বললো, “মতি আজ ওদের ছেড়ে দে। আজ আর পড়াতে হবে না। ”
ওরা মনেমনে বললো, এরা বোকা নাকি? পড়াবে কী দিয়ে?বইতো ব্যাগ সহ হারিয়েগেছে। বই খুজে না পেয়েই তো পালিয়ে যাওয়া। আর চোখ তুলে নিলে আমরা পড়বই বা কী করে?
হঠাৎ মতি বিশ্বাস বলে উঠলেন, “ তোরা ওলিয়ারদের বেড়ার বাইরে ব্যাগ রেখে গিয়েছিলি?”
“হ্যা।”
“সাইদ তখন লাঙল চষছিলো? ”
“হ্যা।“
“ঐ শয়তানই তো বই লুকিয়ে রেখেছিলো। পরে বাড়ি এসে দিয়েগেছে। আর কোনোদিন বই হারাবি? বই যেখানেসেখানে রাখবি? ”
“না।”
“যা। আজ পড়তে হবে না। আজ ছুটি।”
দাদী ডাকলেন, “আয়,খেতে আয়। মতি তুই পরে খাবি। ”ওরা আনন্দে চোখ মুছতে মুছতে ডাইনিং রুমে খেতে চলেগেলো।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: