
শামছুন্নাহার।।
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ,ঈদ মানে ঘোরাঘুরি, ঈদ মানে ভালো ভালো খাওয়া। ছোট বেলার ঈদের কথা মনে হলে নেচে ওঠে মন।
হয়ে পড়ি স্মৃতি কাতর। বাবার স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের পাঁচ ভাই বোনের সংসার ছিল আমাদের। সহায় সম্পত্তি যদিও ছিল, তবে নগদ অর্থের টানাপোড়েন ছিল বেশ। হয়তো কোন ঈদে নতুন জামা পেয়েছি নয়তো নয়। তবে মা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের নতুন জামা কাপড় যোগান দিতে চেষ্টা করতেন। একটা নতুন জামা মানে সেবার কার ঈদ জমজমাট। আর খাওয়া দাওয়া তো আমার মায়ের বাড়ি দেখেছি সবদিন সবসময় ঈদের আয়োজন।
ছোট বেলার ঈদে ফিরি, নতুন জামা কিনে আনার পর বেঁধে যেত হুলুস্থুলুস কান্ড। ভাই বোনের ভিতর বলা বলি গুতাগুতি করতাম।একজন আরেক জনকে বলতাম, আমারটা ভালো তোমারটা ভালো না। এ নিয়ে
হাতাহাতি, এই সময়টা মা সামলাতে গিয়ে মোটামুটি হিমশিম খেতেন।
সাতাশ রমজানে পাড়ার সাথীদের সঙ্গে মেহেদী বাটার আসর জমতো মায়ের শীল পাটায়। এর ভিতর কতটা ফাঁকি দিয়ে বেশী মেহেদী মাখতে পারবো সেই ধান্দাতে ব্যাস্ত থাকতাম।
সাতাশ রমজানের রাত মানে এবাদত বন্দেগি। কে কত রাকাত নফল নামাজ, কে কত পারা কোরআন তেলোয়াত করতে পারি পাড়ার খেলার সায়ীদের নিয়ে তার দারুণ একটা প্রতিযোগিতার আসর বসতো মায়ের বাড়ি। আর মায়ের হাতের তৈরী মজার খাবার চলতো মাঝে মাঝে সাহরীর শেষ পর্যন্ত।
তারপর ঊনত্রিশ রমজানের পরে কিম্বা ত্রিশ রমজানের পরে কখন আসবে সেই মহেন্দ্র ক্ষণ, চাঁদ দেখা মানে সকালে ঈদ।
এই খেলার সাথীদের মধ্যে দল নেত্রী ছিল আমার
ফুপাতো বোন। তাকে আমরা বু বলে ডাকতাম।তার সাথে আমার খুব ভাব ছিল। বুর কথামতো ঈদের রাতে পরিকল্পনা থাকতো সুন্দলপুর বাজারে বড় ঈদের জামাত দেখা ও ওখান থেকে খাবার সহ কিছু মাটির খেলনা কেনা। যে সিদ্ধান্ত সেই কাজ,ঈদের দিন সকালে উঠে খুশবু সাবান দিয়ে গোসল সেরে বুর কাছ থেকে সাজুগুজু করে সবাই ঈদ গাহের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে তারপর আমরা বেরিয়ে পড়তাম এবং নামাজ পড়ে সকলে ফেরার পূর্বে আমাদের কাজ শেষ করে ফিরে আসতাম বাড়িতে। ছুটতে ছুটতে দম বাহির হবার মতো,তার পরেও মনে হতো, ঈদের খুশি তো এখানে।
তারপর আস্তেধীরে বড়ো হওয়া, সেই বুরও প্রেম পরিণয় সুত্রে বিয়ে হয়ে যাওয়া। আমার বড় আপারও বিয়ে, আমি একেবারে একা। এভাবে কাটতে কাটতে আমারও বিয়ের সানাই বেজে গেল। তেইশে পা রাখা টগবগে এক যুবকের সাথে প্রেম, পরিণয় সুত্রে বিয়ে।
বিয়ের পর প্রায় প্রতিটি ঈদই আমার ওনার সাথে ওনার বাড়িতে করতে হতো। কারণ আমার উনি চাকুরীর সুবাদে সবসময় এলাকার বাইরে থাকতেন। বিয়ের কিছু দিন পরে আমারও চাকুরী হওয়াতে বেশ কয়েক বছর ওনার সাথে থাকার সৌভাগ্য হয়নি। তাই উনি আসার খবর পেয়ে আমিও ভুলে যেতাম মায়ের বাড়ি যাওয়ার কথা। উনার আগমন বার্তায় আনন্দে নেচে উঠতো মন, নেচে উঠতাম আমি। গাইতে ইচ্ছা করতো, তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণোনাথ আসিতেছে। উনি আসার পর শুরু হতো আসল কেনাকাটা। আব্বা, মা, শাশুড়ী, জা, ভাশুর, ননদ সহ এই ছয় জনের কাপড় কেনা এবং তাঁদের কাছ পর্যন্ত নিজ হাতে পৌঁছে দেওয়া আমার আর একটা অন্যতম ঈদের আনন্দ ছিল। তারপর শ্বশুর বাড়িতে অনেক লোক অনেক আত্মীয়।ঈদের সকালে পরিপাটি হয়ে শাশুড়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম ঈদের
বাজারে,শাশুড়ীকে বিভিন্ন পদের খাবার কিনে আঁচল ভরে আবার ফিরতাম বাড়িতে। এটা সম্ভব হতো ঈদগাহ
ও ঈদের বাজারটা বাড়ির কাছে থাকাই। রান্না ঘরেই কাটতো দুই দিনের বেশীর ভাগ সময়। তা সত্বেও ওখানে ঈদের আমেজটা বেশীই অনুভূত হতো।
ঈদের দুই দিন পরে রওনা হতাম মায়ের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। মায়ের বাড়িতে এসে তখনকার সাথীদের কাউকে পেতাম কাউকে পেতাম না। অনেকের আমার মতো শ্বশুর বাড়ির দায়বদ্ধতায় পেয়ে বসেছে, আবার কারো কারো মা বাবা পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। যে সব আপনজনেরা বেঁচে আছে তাদের অনেকে তারা নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। বিশেষ করে ভায়েরা। আজকাল কয়টি ভাই বোনের খোঁজ রাখে?
আমরা বোনেরাও এমন হয়ে গেছি আমরা মনে করি খোঁজ করাটা শুধু ভায়ের দায়বদ্ধতা। এটা একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়ে গেছে। ভাই বোনের ভেতর একে অপরের খবরাখবর রাখলে হৃদ্যতা বাড়ে বৈকি কমে না।
নবীজি সঃ বলেছেন তোমরা তোমাদের আত্মীয়ের
সাথে সুসম্পর্ক না রাখলে কেউ জান্নাতে যেতে পারবেনা। তাই আমাদের উচিত রক্তের আত্মীয়ের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখা।
ঈদের আনন্দ আজ অনেক খানি ফিকে হয়ে গেছে। আজ আর অনেকে বেঁচে নেই। করোনার ভয়াল থাবায় হারিয়ে গেছে অনেকে। ঘর হতে বাহির হওয়াটা কঠিন। আত্মীয় স্বজন কেউ কারো বাড়ি আসা যাওয়া ও নেই। সেই ঈদগাহে দুবছর ধরে ঈদের জামাত হয় না। স্বল্প সংখ্যক মুসল্লী নিয়ে ঈদের জামাত হয় মসজিদে। কোলাকুলি নেই, নেই হাতে হাত মেলানো।
আমার সে বুও আজ বেঁচে নেই। বু ছোট ছোট তিনটি ছেলে রেখে পরপারে চলে গেছে। আজ-ও
বুর কথা মনে হলে হৃদয়টা হুহু করে কেঁদে ওঠে। বু তোমার অনেক কষ্টের জীবন ছিল। আজ তুমি যেখানে
রয়েছো আল্লাহ সবসময় যেন ঈদের আনন্দ নিয়ে থাকার তৌফিক দেন। পরপারে ভালো থেকো বুবু।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: