কবি ও সাহিত্যিক সফিয়ার রহমানের লেখা ছোট গল্প- একাত্তরের কনেক

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৭ মে ২০২১ ০৫:০৭

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৭ মে ২০২১ ০৫:০৭

ছবি সমসাময়িক
  রাত পোহাবার এখনও বেশ বাকি। শিয়ালগুলো শেষ প্রহরে সেদিনের মত শেষ সমবেত ডাক দিয়ে থেমে গেল। মুরগির কোঠায় বন্ধি যৌবনপ্রাপ্ত ডান পিটে মোরগ বা মুক্ত বনের পাখি ঘুম জাগানিয়া ডাক শুরু করেনি। শিশির ভেজা জোৎস্না রাত। পাতায় জমা শিশিরের গড়িয়ে পড়ার শব্দ ভেদ করে কামার পাড়া থেকে তালে তালে লোহা পেটানো টক টক শব্দ কানে ভেসে আসছে। না দেখেও শব্দ শুনে বুঝতে পারছি কনেক তার মামার সাথে লোহা পেটাচ্ছে। শান্তি কামার বড় কাঠের পিঁড়ের উপর বসে জাতার দড়ি টেনে কয়লায় আগুন জ্বালাচ্ছে। লোহা পুড়ে কমলা রঙ ধারণ করছে। সাঁড়াশি দিয়ে ধরে এনে লোহার পাতের উপর রেখে ছোট হাতুড়ি দিয়ে ঠুং করে একটা ঘা দিচ্ছে, কনেক বড় হাতুড়ি দিয়ে সেই জায়গায় জোরে আঘাত করছে। শান্তি কামারের ছোট হাতুড়ির শব্দ এবং কনেকের বড় হাতুড়ির ছন্দময় শব্দ তৈরি হচ্ছে। ঘুমঘোরে দূর থেকে শুনতে বেশ মজা লাগছে। কনেক আমাদের খেলার সাথী। ওর মা বাবা কেউ নেই। মায়ের বুকের দুধ কয়দিন খাওয়ার পর মা পরপারে চলে গেল। বাবা পুনরায় বিয়ে করে তিন তিনটে নতুন মুখ উপহার দিয়ে মায়ের পথ অনুসরণ করলো। সৎ মা অভাবের সংসারে কনেককে বাড়তি বোঝা বহনে ব্যর্থ হয়ে দাঁতের উপর নিত্য ভাঁজতে শুরু করলো। নিজেদের বাড়িটাই কনেকের কাছে নরক মনে হতে লাগল। ঘুম থেকে উঠেই কনেক গ্রামে হারিয়ে যায়। এবাড়ি ওবাড়ি, মাঠ ঘাট ঘুরে ঘুরেই দিন পার হয়ে যায়। গ্রামে হাতেগুণা কয়েক ঘর বাদে সবার বাড়ি ভাতের অভাব। ক্ষুধার্থ কনেক ভাত চেয়ে খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেল। অনেকেই একমুঠো ভাত কনেককে দেয় তবে মুখটা গম্ভীর করে। কনেকের এটা মোটেই পছন্দ হয় না। কনেক আয়ত্ব করলো কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা এবং অঙ্গভঙ্গি। যা তার চলার পথকে বেশ সহজ করে দিল। গ্রামের হিন্দু মুসলমান সব বাড়িতে তার অবাধ বিচারণ। মা বাবাহীন গোলগাল কালো শরীর, উসকো খুসকো কাকের বাসার মত মাথায় চুল, কনেকের ময়লা দাঁতের হাসি সবার মন জয় করে নেয়। গ্রামে আজ মোল্লা বাড়ির মেয়ের বিয়ে। সারা বাড়ি ব্যস্ততার ধুম লেগেছে। কনেক ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে ঘেমে নেয়ে একাকার। সমবয়সী বন্ধুদের সাথে ক্ষুধা পেটেও মনের আনন্দে কাজ করে যাচ্ছে। গোশ দোঁ পিয়াজার লোভনীয় খুশবু বাতাসে ভেসে আসছে। কনেকের আর তর সইছে না। সেই সকাল বেলা সরদার বাড়ির বড় গিন্নী এক শানুক পান্তা ভাতের আমানীর মধ্যে এক মুটো ভাত ফেলে দিয়েছিল। বিয়ে বাড়ির ঝৈ ঝামেলা শেষে কাজের লোকেদের সাথে কনেক খেতে বসল। দুই টুকরা গোশ তার পাতে পড়ল। আরও গোশ চাইলেও পাওয়া যাবে না তাই একটু ঝোল চেয়ে নিল যেন বেশি করে ভাত খাওয়া যায়। খেতে খেতে খাজিমদার দৌড়ে এসে আরও এক টুকরা গোশ কনেকের পাতে দিল। কনেক হেসে উঠলো, খাজিমদার মুখ চেপে হাসছে। কনেক গোশ খাওয়ার পর খাজিমদার জোরে হেসে উঠলো। সারা বিয়ে বাড়ি ছাড়িয়ে হিন্দু পাড়ায় পৌঁছে গেল কনেক গরুর গোশ খেয়েছে। কনেক বুঝে উঠে পারছে না গরুর গোশ খেলে কি হয়। বাড়িতে গেলে সৎ মা বটি নিয়ে তাড়া করেছিল। পাড়ার বুড়িমারা গালিগালাজ করতে লাগল। চোখ রাঙ্গিয়ে তাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় প্রবেশ নিষেধ করে দিল। অগত্যা রাতে সরদার বাড়ির পাটের গাঁদার উপর শুয়ে পড়ল। কুকুরের উৎপাতে শেষ রাতে ঘুম ভেংগে গেল। মায়ের আদর অনুভব করছে কিন্তু মায়ের মুখ মানষ পটে ভেসে উঠছে না। মায়ের মুখ সেই ভাবে দেখার সুযোগতো কনেকের হয়নি। তার আগেই মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। দিদিমার আদরমাখা মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। সিদ্ধান্ত নিল, দিদিমার কাছে যাবে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে গ্রামের মায়া ত্যাগ করে দিদিমার উদ্দেশ্যে মদনপুর যাত্রা করল। কনেক দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল। মামা শান্তি কর্মকার উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। কনেকের কান্নায় তারও মন কেঁদে উঠল। গলা ভারি করে বলল, তোর আর শাহাপুর ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। হনে তোর কিডা আছে যে তার মায়ায় থাকপি। আমার কাছে থাকপি, নুন ভাত যা জোটে তাই খাবি। কনেকের মামী মুখ ঝামটা দিয়ে এক খুচি চাল নিয়ে রান্না ঘরে ডুকল। শান্তির মা তা দেখে একদলা থুথু ফেলল। বউমা রান্নাঘর থেকে আড়চোখে তাকাল। বউ শাশুড়িতে নিরবে এক তরফা হয়ে গেল। শান্তি কর্মকার কিছুই বুঝতে পারল না। কনেক মদনপুর গ্রামের সব মানুষের মন জয় করে ফেলেছে। ছোট মানুষ রস রসিকতা মিশিয়ে পাকা পাকা কথা বলে, এতেই মানুষের মন ভিজে যায়। দুই একজন বেরসিক মানুষ মাওড়া ধুড় বলে হেয় করে, তাতে কনেকের কিছুই আসে যায় না। মামার কাছে আবদার করে আম ছুলে খাওয়ার জন্যে একটা ছোট্ট ছুরি বানায়ে নিয়েছে, সেই ছুরি দেখিয়ে দৌড়ে পালায়ে যায়। কনেক মামার সাথে লৌহা পেটাচ্ছে, পাড়ার মহিলাদের উঠোনের ধান পল তুলে দিচ্ছে। কারও তেলের বা কেরোসিনের শিশি বোতল নিয়ে হিরো মহলদারের দোকান থেকে কিনে এনে দিচ্ছে। সারাদিন কনেকের কাজ যেন ফুরায় না। মদনপুর মসজিদের সামনে বড় খাশি ছাগল জবাই হয়েছে। রান্নার আয়োজন চলছে। আজ খোদার নজর হবে। পাশের গ্রামে কলেরা দেখা দিয়েছে। খরচ বাবদ সমান চাঁদা দিয়ে সবাই এক আধ পিচ মাংশ খাবে। তাতে রোগ ব্যাধি বালা মুছিবত দুর হবে। গ্রামের হিন্দুরা এতে যোগ দেয় না। কনেক গোশ খাওয়ার লোভে শ্রম দিয়ে দুই পিচ খেয়ে নিল। জোরে জোরে বলল, আল্লাহ আমার যোনো বাবা মার মত তাড়াতাড়ি মৃত্যু হয়। দেলবার কুদা লাঠি নিয়ে শালা বলে তাড়া করল। কনেক রাতের আঁধারে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কয় মাস আগে মদনপুর স্কুলে নৌকা - হারিকেন মার্কার ভোট হল। গ্রামের লোক পান চুন বিড়ি খেয়ে নৌকায় ভোট দিয়েছিল। কিছুদিন বাদেই লোকজন বলাবলি করছে, দেশে নাকি গন্ডগোল হচ্ছে। পাকিস্থানের সাথে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। বেলা বারটার দিকে যশোর থেকে কয়েকজন যুবক সাইকেল চালিয়ে মদনপুর স্কুলে এল। তারা যশোর এম এম কলেজে পড়ে। স্যারদের সাথে শলাপরামর্শ করে স্কুলের ছেলেদের নিয়ে রাস্তায় মিছিল বের করল। যশোরের ছেলেরা মিছিলের সামনে গিয়ে বলছে, নারায়ে তাকবির। স্কুলের ছেলেরা চিল্লায়ে বলছে, আল্লাহু আকবার। ভুট্টো ইয়াহিয়া দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই ইত্যাদি শ্লোগানে গ্রাম কেঁপে উঠল। গ্রামের লোক কাজ ফেলে তাকিয়ে দেখছে। এই প্রথম সাধারন মানুষ বুঝল দেশে কিছু একটা হচ্ছে। মকছেদ সানা বলল, কি দরকার বাপু এসব আন্দে ভ্যাজালের। ছেলেপিলে কডা চ্যাঁচায়ে মরতেছে। যত সব নছেল্লাহ। পাখির কলোরব থেমে গেল। শহর থেকে বাড়িঘর ফেলে মানুষ দলে দলে গ্রামের দিকে আসছে। স্কুলের জীর্ণ ঘরগুলো শহরের শৌখিন মানুষ দখল করে নিল। আতœীয়তার সুবাদে অনেকের বাড়িতে উঠেছে। শহর এবং গ্রামের মানুষ একত্র হয়ে হতাশায় দিন পার করছে। হিন্দু সম্প্রদায় দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। মদনপুর হিন্দু পাড়ায় নির্ঘুম রাত পার করছে। গ্রামের অনেকেই সাহস দিচ্ছে কিন্তু তাদের আতঙ্ক কাটছে না। হঠাৎ হিন্দু পাড়ায় রাতে গ্রামের লোকই লুট করল। ঐ রাতেই টোল টুপলা বেঁধে তারা ভারতে চলে গেল। কনেকও মামার সাথে চলে গিয়েছে। শান্তি কর্মকার বনগাঁয় তার শ্বশুর বাড়ি উঠেছে। তারাও গরিব মানুষ। ভাল ঘর দরজা নেই। শান্তি কর্মকারের মা এবং কনেকের থাকার জায়গা হল রান্না ঘরের বারান্দায়। চটের ছালা টাঙ্গিয়ে ঘর মত করে নিয়েছে। রাতে শান্তির মার ঘন ঘন প্রস্্রাব লাগে। বুড়ি মানুষ চোখে ভাল দেখতে পায় না বিধায় ঘরের পাশে প্রস্্রাব করে। কয়েকদিনের মধ্যে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। এনিয়ে বুড়ির সাথে শান্তির শাশুড়ির বেশ ঝগড়া হল। বুড়ি শান্তিকে ডেকে বলল, আমার মরণ হয় হবে তবুও আমি দেশে ফিরে যাব। এখানে এক দন্ডও থাকব না। অনেক কথার পর বুড়ি কনেকের হাত ধরে বাড়ি ফিরে এল। হিন্দুপাড়াটা খাঁ খাঁ করছে। আপনজনেরা কেউ নেই। ঘরের জানালা দরজা পর্যন্ত লুটেরারা খুলে নিয়ে গেছে। চকচকে উঠোনে ঘাস গজিয়েছে। খবর পেয়ে আশপাশের লোক দেখা করতে এল। বুড়ি মানুষ তাই প্রতিবেশি মহিলারা সকাল বিকাল খোঁজ খবর নেয়। শাক সবজি চাল ডাল দিয়ে সহযোগিতা করে। শান্তির মা জানালা দরজা বিহীন ঘরে থাকে। আপন গৃহ তাই ভয় শংকা থাকা সত্বেও ঘুম হয়। লোকশূণ্য পাড়ায় বিকেলবেলা ঘুরতে ঘুরতে কেতুর মার কথা মনে পড়ল। ঐ বারান্দায় বসে কত গল্প করেছি, পান খেয়েছি। আজ কেউ নেই। ঘর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে কে কোথায় কেমন আছে ভগবানই জানে। ভগির ঘরের পিছনে মা দূর্গার একটা ছবি পড়ে আছে। তুলে নিয়ে ঝেড়ে মুছে কাপড়ের নিচে সেরে ফেলল। ঘরে ফিরে মাথার কাছে দেয়ালে বেঁধে রাখল। সকালে ফুল কুড়িয়ে আপন মনে পুজা করে। কনেক দেখে ধমক দিয়ে বলল, বাঁচতি চাওতো এক্ষুণি ফ্যালাই দেও। রাজাকাররা দেখতি পালি তুমার জবি করবেনে। দিদিমা হাত তুলে সেবা দিয়ে বলল, তাও ভাল, কিন্তুক ফ্যালাই দিবান না। কনেক প্রতি সপ্তায় পঁচিশ মাইল পথ হেঁটে বনগাঁয় যায়, দুই একদিন থেকে আবার ফিরে আসে। কনেক এদেশ থেকে সোনা রুপার আংটি, কানের দুল জাতীয় কিনে নিয়ে বনগাঁয় বিক্রি করে বেশ টাকা হাতে এসেছে। মনের আনন্দে ‘সময় এখন বর্ষাকাল হরিণ চাটে বাঘের গাল’ গানের এককলি বার বার গাইতে থাকে। দেশের রাজনৈতিক নেতারা জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কনেককে হাতে পেয়ে বাড়িতে চিঠি বা প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র পাঠায়। নেতাদের বাড়ি থেকে মুরগির গোশ, ছিঁটেরুটি দিনের দিন কনেক পৌঁছে দেয়। কনেকের ওপারে একটা আলাদা কদর বেড়েছে। সবাই আদর করে, খেতে, থাকতে দেয়। বাড়ি ফিরে কনেক দিদিমাকে একটা পাঁচ শ টাকার নোট দেখাল । দিদিমা বলল, তোরতো বেশ বুদ্ধি হয়েছে। সাবধানে রাখিস। দিনকাল ভাল না। হ্যারে কনেক তুইতো এখন ম্যালা টাকার মালিক। হাটে যায়ে ওল আর নোনা ইলিশের ঘাড়ো কিনে আনতি পারিস। খাতি বিজায় মন চাচ্ছে। কনেক দুই আঙ্গুল দিয়ে তুড়ি ফুটিয়ে বলল, ওতো আমার কাছে ওয়ান টুর ব্যাপার। আজই খাইটরোর হাটেত্তে কিনে আনবানে। যুদ্ধ চলছে, এরই মধ্যে দুইদিন রাজাকারেরা এসে গ্রাম ঘুরে গেছে। একরাতে রাজাকারেরা মহাতাব নগরের আনার এবং মোলাম চোরকে ধরল। আনার এবং মোলাম দুই ভাই। এলাকায় তেমন একটা চুরি করে না। সুন্দরবনে নৌকা নিয়ে সুন্দরী কাট কেঁটে এনে ঝিকরগাছা বাজারে হালিম সাহেবের কাঠগোলায় বিক্রি করে। রাজাকারেরা দুই ভাইকে ধরে মণিরামপুর ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। গভীর রাত, চার পুকুরের কাছে এসে দুই ভাই ছুঁটে ঝাঁপ দিল পুকুরে। কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে গেল। রাজাকারেরা সঙ্গে সঙ্গে ষ্টেনগান দিয়ে সারা পুকুর ব্রাশ ফায়ার শুরু করল। দুই ভাইই মারা গিয়েছিল। পরের দিন আনার মোলামের আপনজনেরা পুকুর থেকে টেনে উঠাল লাশ। পাকিস্থানী সৈনিক মদনপুর কোন দিন আসেনি। এবছর প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। যাতায়াতের রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা। গাড়ি আসতেই পারবে না। ডুমুরখালিতে যুদ্ধ হয়েছিল। পাকিস্থানী সৈনিকেরা হেরে পিছু হটেছিল। মদনপুরের ভিতর দিয়ে দৌড়ে ঝিকরগাছা পৌঁছে ছিল। জীবনের ভয়ে তারা দৌড়াচ্ছে, গ্রামবাশিও তাদের ভয়ে জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। পরে কনেক কে কি ভাবে পলায়েছিল তা বর্ননা করে অনেক হাসালো। শেষ বিকেলে কনেক খাটুরার বাজারে গেল। ওল ও নোনা ইলিশের ঘাড়ো কিনে পাঁচ শ টাকার নোট আর ভাঙ্গাতে পারছে না। কারও পকেটে টাকা নেই। এই সমস্যা কনেকের প্রতিবেশি মেল্লেক চান পরে দেব বলে কয়ে বাকিতে রফা করল। মেল্লেক চান মুখে গামছা বেঁধে হিন্দু বাড়ি লুট করেছিল। ঐ লোভে এখন সুযোগ মত অতি গোপনে ডাকাতিও শুরু করেছে। মেল্লেক চান আদর করে কনেককে কাছে ডাকল। ওপারে কে কোথায় কি ভাবে আছে খোঁজ খবর নিতে লাগল। কনেককে গোলগুল্লাহ ভাজা কিনে খাওয়ালো। কনেককে হাটের মধ্যে ঘুরাতে ঘুরাতে সন্ধ্যে করে ফেলল। তারপর মেল্লেক বলল, চল কনেক বাড়ি যাই। খাটুরা মদনপুরের মাঝখানের মাঠে এসে মেল্লেক কনেকের মূহুর্তের মধ্যে দুই হাত পিছনে নিয়ে ঘাড়ের গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলল। মুখে আর এক টুকরা কাপড় জোর করে ডুকিয়ে দিল। ধাক্কা দিতে দিতে পাশের পাট ক্ষেতে নিয়ে গেল। অসুরের মত শক্তি নিয়ে ফোঁস ফোঁস করে দম ফেলতে লাগল। ছোট মানুষ কনেক বিড়ালের সামনে ইঁদুরের মত বাঁচার চেষ্টা করে কোন লাভ হল না। গলা টিপে কনেককে হত্যা করে পকেট থেকে পাঁচ শ টাকা তুলে নিল। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি চলে এল। যুদ্ধের সময় সন্ধ্যের পর আলো নিভিয়ে সবাই নিস্তব্দ হয়ে যায়। মেল্লেকের স্ত্রী কাছে এসে বলল, হাঁপাচ্ছাও ক্যানো, কি হয়েছে? কিছু না, বুনো শোরে তাড়ায়েছে। পানি দে এক কলসি। সব পানি খায়ে ফ্যালব। সারা গ্রাম বিষাদের ছায়া নেমে এল। কনেককে শেষবারের মত এক নজর দেখার খুব ইচ্ছা হল। বাড়ি থেকে রওনা হয়েছি, পথে বাঁধা দিয়ে মা বলল, কোথায় যাবি? কনেককে দেখলে ছোট মানুষ ভয় পেয়ে মরে যাবি। খবরদার গেলে তোর বাপকে বলে দেব। মহিলারা কনেকের জন্যে বেশি কাঁদছে। কনেকের দিদিমা ভেবেছিল কনেক মনে হয় হুট করে বনগাঁয় চলে গিয়েছে। যখন তার কানে খবর এল কনেক পাট ক্ষেতে মরে পড়ে আছে। কোন টুশব্দ না করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দু’চোখ বেয়ে গলগল করে পানি ঝরছে। আনোয়ারা দৌড়ে এসে হাতের তালুতে সর্ষের তেল পানি দিয়ে ফ্যানায়ে মাথার তালুতে দিয়ে দিল। অন্যেরা খাওয়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু কোন খাবার মুখে দিল না। কনেক পাট ক্ষেতে দুইদিন পড়ে আছে। শেষকৃত্য করবে কে? এলাকায়তো কোন হিন্দু নেই। রাজাকারের ভয়ে কেউ মাটি চাপা দিতেও রাজি হচ্ছে না। জমির মালিক পড়ল বিপদে। ক্ষেতে একটা মানুষ পঁচে গলে যাবে তাতো হয় না। শিয়াল এবং কুকুর মানুষের মাংশ খেয়ে হণ্যে হয়ে গিয়েছে। শিয়াল এবং কুকুরের মধ্যে দিনের বেলায়ও যুদ্ধ চলছে। এর মধ্যে ছোটছেলে বলেই দিল, ঐ ক্ষেতে সে আর জীবনেও লাঙ্গল চষতে যাবে না। তার খুব ভয় করছে। অগত্যা তুরাফ মোড়ল তার বড় ছেলেকে নিয়ে নাকে ভাল করে গামছা বেঁধে কনেকের পায়ে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে ভাগাড়ের পাশে শিমুল গাছটার নিচে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিল। কনেকের দিদিমা ধাতস্থ হয়ে আনোয়ারাকে রাজি করিয়ে তার হাত ধরে কনেকের সমাধি দেখতে গেল। আহারে আদরের কনেক সারা ভাগাড় ছড়িয়ে পড়ে আছে। শিয়াল গর্ত থেকে টেনে তুলেছে। বুড়ি হা করে বিনা শব্দে কাঁদছে। প্রবল বৃষ্টিতে কনেক হারিয়ে গেল বাংলার মাটিতে। বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য নবরুপে আলোকিত করে তুলল। কর্মকার পাড়ায় লোহার সাথে হাতুড়ির আঘাতের পুরাতন সুর নতুনরুপে শুরু হয়েছে। কনেকের দিদিমা স্বাধীনতার আলো বাতাস বেশি দিন ভোগ করা হল না। পরপারের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল। বল হরি, হরি বোল বলতে বলতে তাকে নিয়ে চলেছে শ্বশানে। আনোয়ারাকে কনেকের দিদিমা খুব ভালবাসতো সেও চলেছে পিছন পিছন। ভাগাড়ের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছে তখন আনোয়ারা মনে মনে বলল, কনেকরে তোর দিদিমা তোর কাছে যাচ্ছে দেখে রাখিস।

লেখক, শফিয়ার রহমান একজন শিক্ষাবিদ,  কবি, বিশিষ্ট ছড়াকার, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট। 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: