
সাজেদ রহমান।।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশ করেন যশোরের বিপ্লবী গোপালদাস মজুমদার। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’ প্রকাশের জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। বিপ্লবী গোপালদাস মজুমদারের বাড়ি যশোরের বাগডাঙ্গা গ্রামে, জন্ম ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে, পরলোক গমন করেন ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর পিতার নাম প্রভাসচন্দ্র মজুমদার। ছোট বেলা থেকেই বিপ্লবী পরিবেশে মানুষ। কলকাতার মানিকতলা বোমা-মামলাখ্যাত জ্যোতিষ মজুমদার তাঁর মাধ্যম অগ্রজ। রাজশাহী থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে খুলনার দৌলতপুর কলেজে পড়ার সময় তিনি বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে জড়িত হন এবং শ্রীঅরবিন্দ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, বাঘা যতীন প্রভৃতির সান্নিধ্যে আসেন। পরে দল ভেঙ্গে গেলে বারীন ঘোষের ‘বিজলী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর নানা কারণে ওই পত্রিকার সহকর্মী বন্ধু বিধুভূষণ দে’র সঙ্গে মিলিতভাবে একটি রাজনৈতিক পুস্তকের দোকান খোলেন-‘দে মজুমদার’ নাম দিয়ে। পরিচালনার ভার ছিল বিধুবাবুর উপর। তিনি ছিলেন স্বত্বাধিকারী এই সংস্থায় কলকাতায় বর্তমান ডি.এম লাইব্রেরি। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনিই এই প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী হন।
এখন কলকাতার বিধান সরণি, তখন ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। আজ থেকে ৯৯ বছর আগে ৬১ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের একটা ছোট্ট ঘরের সামনে নিতান্ত সাধারণ এক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিলেন বছর বত্রিশের এক যুবক। নাম গোপালদাস মজুমদার। প্রকাশনা-ব্যবসায় নামছেন, সঙ্গী বন্ধু বিধুভূষণ দে। পুঁজি মাত্র ৩০০ টাকা। সংস্থার নাম দিলেন ‘ডি এম লাইব্রেরি’। বন্ধু বিধুভূষণ দে আর নিজের পদবি মিলিয়ে সংস্থার নাম হল ‘দে মজুমদার’, সংক্ষেপে ডি এম লাইব্রেরি। বিধুভূষণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শুরু ১৯২১ নাগাদ, ‘বিজলী’ পত্রিকার দপ্তরে। হিন্দুস্থান ইনশিয়োরেন্সের চাকরি যাওয়ার পর তিনি তখন বেকার। মেজদা, বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র মজুমদার তাঁকে নিয়ে গেলেন বিজলী পত্রিকা দপ্তরে। শ্রীঅরবিন্দের বোন সরোজিনী দেবী তখন কর্মী নিয়োগের বিষয়টি দেখতেন। তাঁর সুপারিশে বিজলী-র সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ জুটে গেল গোপালদাসের। বেতন ২৫ টাকা। বিধুভূষণ তখন ম্যানেজার। বন্ধুত্বের সেই সূচনা। বছর দেড়েকের মাথায় তাঁদের যৌথ চেষ্টায় ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশ পেল বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের লেখা বই ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’, শচীন সেনগুপ্তের ‘চিঠি’, বারীন্দ্রের ‘মুক্তির দিশা’, নলিনী গুপ্তের ‘স্বরাজ গঠনের ধারা’ আর সুরেশ চক্রবর্তীর একটি কবিতার বই। ‘বিজলী’র কাজও চলছিল। কিন্তু পুরোপুরি প্রকাশনায় নামার ইচ্ছে তখন চেপে বসেছে তাঁর মনে। অতএব ঝুলিয়ে দিলেন সেই সাইনবোর্ড।
শুরেতেই বিপর্যয়। ব্যবসার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিধুভূষণ ত্যাগ করলেন সম্পর্ক। গোপালদাস স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমার শুরু কিন্তু আমার পার্টনারের সঙ্গে বিচ্ছেদ। দোকান চলবে কিনা, ধারদেনাগ্রস্থ হয়ে পড়বো কিনা এই সব নানাকথা ভেবেচিন্তে আমার পরম সুহৃদ সহকর্মী বিধুভূষণ দে ডি এম লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে কাগজে এক বিজ্ঞপ্তি দিলেন কিন্তু আমি দমলাম না।’ বন্ধুবিচ্ছেদ হল, বিজলী-র চাকরিও গেল। দৈন্যদশা তখন। দোকানের সামনে ফুটপাতে টুলের ওপর বসে কার্যত মাছি তাড়ানো। কিন্তু ব্যবসার নেশা ছাড়ল না তাঁকে। বদলালেন না সংস্থার নামও। বিজলী-র অফিসে তাঁর আলাপ হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। আলাপ ক্রমে গড়াল গভীর বন্ধুতায়। এক দিন নজরুল এসে বললেন, ‘‘গোপালদা, আমার বই ছাপবে?’’ নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’ তখন বিপুল জনপ্রিয়। প্রকাশকের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি ওই দুটি বই তুলে নিয়ে ছাপতে দিলেন গোপালবাবুকে। সঙ্গে ‘বিষের বাঁশী’। হাতে চাঁদ পেলেন যেন গোপালদাস। ছাপলেন পরম যতেœ। কিন্তু ‘বিষের বাঁশী’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করল। প্রকাশক গ্রেফতার হলেন। দোকানের সব বই খোয়া গেল। এক রাত্তির হাজতবাস। তবু আখেরে লাভ হল তাঁর। ‘শাপে বর হল, দপ্তরিখানায় কিছু বিষের বাঁশী বাঁধাবার জন্যে পড়েছিল। পুলিশ তার সন্ধান পায়নি। ঝড়ের হাওয়ায় গোপন রক্ষিত সেই বই সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে গেল।
৯১ বছর বয়সে বাংলা ১৩৮৭ সালে যখন প্রয়াত হন, বাংলা প্রকাশনার জগতে তখন তিনি ইতিহাস। তত দিনে ৬১ নম্বর ঠিকানা থেকে ডি এম লাইব্রেরি চলে এসেছে ৪২ নম্বর বাড়িতে। মেজদা, বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্রের হাত ধরে বিপ্লবী দলে নাম লিখিয়েছিলেন কৈশোরে। মেজদাই শিখিয়েছিলেন রিভলভার চালানো। বিপ্লবীর জেদটা বুকের মধ্যে জিইয়ে রেখেছিলেন গোপালদাস। প্রকাশনা জগতে এমন বিরল ধারা তৈরি করেছিলেন গোপালদাস। আজও যা রক্ষায় ব্রতী গোপালবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র, ডি এম-এর বর্তমান কর্ণধার আশিস গোপাল মজুমদার।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: