
তখন আমার বয়স আড়াই কি তিন, সে সময় আমি মুক্ত স্বাধীন । ঢোকেনি তখন কোন কিছুর চিন্তা,
বুঝতে শিখিনি সোজা বাঁকা রাস্তা। বুঝতাম শুধু আদুরে আবদার, বুঝতে পারতাম না মায়ের কারণ ব্যস্ততার।
মামা তখন মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীন করার লক্ষে
নেমে পড়েছেন। মামা থাকতেন মায়ের কাছেই, তাঁকে যাবতীয় সহযোগীতা করতেন মা। তাঁর লেখা পড়া,তাঁর থাকা খাওয়া, তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার ব্যাপারে সকল সহযোগিতা মা-ই করতেন। মামা যখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন
তখন প্রথম দিকে মা বাঁধ সাধলেও পরে মামা মাকে বুঝাইতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারপর মামাকে মা বলেছিলেন, হ্যাঁ ভাই যা,দেশ স্বাধীন কর। দেশের জন্য নিয়ে আয় স্বাধীন পতাকা।
মামা যুদ্ধের প্রশিক্ষনে চলে গেলেন ভারতে,ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোটা ছিল আমার নানার বড় অপরাধ, সেই অপরাধের দায়ে রাজাকারের বুলেটের আঘাতে জীবন দিতে হয়েছিল আমার নানাকে। মামা হারিয়ে ছিলেন তাঁর বাবাকে।এত বড় ত্যাগের পরে ও নানা আমার স্বাধীন সোনার দেশ দেখে যেতে পারলেন না। নানা আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি,সাথে আপনার রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে নেমে পড়লেন যুদ্ধে।
দীর্ঘ নয় মাস চললো রক্তক্ষয়ী লড়াই। যুদ্ধ করতে করতে যখন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত তখন গোপনে যুদ্ধের টীমের সকলকে নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন, ভাত খেতে। মা ব্যস্ততার সহিত স্বযতনে রেঁধে খাওয়াতেন । ছোট একটা গল্প এখানে না বললে হয় না, মা যখন রান্না বান্না নিয়ে ব্যস্ত,তখন আমি মামাদেরকে অস্ত্র সহ দেখে ভয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে পুকুর পাড়ে তাল গাছ আর নারিকেল গাছের মাঝে বসে থেকে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ি মা তা খেয়ালই করেননি। এদিকে মায়ের কোলে আমার পরের ভাইটার বয়স মাস ছয়েক
মামাদের খাইয়ে মা মামাদের নিকট বন্দুক চালানো প্রশিক্ষন নিচ্ছিলেন, আমি যেখানে ঘুমিয়ে আছি, ঐ দিকটা ফাঁকা পেয়ে ঐদিকে তাক করে ধরে মাকে বন্দুক চালানো শেখাচ্ছিলেন। মা কিছু বুঝে ওঠার আগে, কোথায় চাপ লেগে জানি কয়েক রাউন্ড গুলি বেরিয়ে যায়। এদিকে বন্দুকের গুলি ধেয়ে এসে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, অন্য দিকে ঘুমানো যায়গা, প্রায় লাগোয়া পুকুর ভরা থৈ থৈ পানির সাথেই। সব মিলিয়ে মৃত্যু কাছ থেকে ঘুরে চলে যায়। সবই আল্লাহর রহমত। কথায় আছে না,রাখে আল্লাহ মারে কে? আমি কিন্তু তখনও ঘুমাচ্ছি।
মা মামাদের বিদায় দিয়ে, ভাইয়ের দরদে শাড়ির
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে দেখেন আমি নেই ঘরে। তখন মা চিতকার দিয়ে কেঁদে উঠে বলেছিলেন আমার মেয়ে কই? আমার মেয়ে কোথায় গেলো? আমার মেয়ে কই? তোরা খোঁজ। হন্যে হয়ে সব যায়গা খোঁজা শেষে কেউ একজন আমাকে আবিষ্কার করেছিলো সেই তাল গাছ আর নারিকেল গাছের মাঝ খানে পুকুর পাড়ে ঘুমন্ত অবস্থায়। মা আমাকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে যে কত কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন, আজ আমার মেয়েকে তো চিরতরে হারিয়ে ফেলতাম। বরাবরই আমি নাদুসনুদুস থাকাতে মামা সেই ছোট বেলা থেকে আমাকে খুব আদর করতেন। আমি যে দিন সরকারি চাকুরীতে জয়েন করি, সেদিনও মামা
আমাকে কলেজ থেকে বাইকে উঠিয়ে এনে সাথে থেকে জয়েন করিয়ে ছিলেন। যত গুলো ভাগনা ভাগনে আছে, তার মধ্যে মামা মামিকে নিয়ে আমার কাছে একটু বেশি সময় কাটিয়ে গেছেন।
মামার একটা কথা বেশি মনে পড়ে সেটা হলো সোফায় বসে চোখ বন্দ করে পা দুলিয়ে বলতেন আমাকে, মাগো আমি এখন কি খাব? আমার মামা পেশায় একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মামার কথা মনে হলে খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।
মামার দলে বেশ কয়েক জনের মধ্যে খান টিপু সুলতান সাহেব ও ছিলেন। মামা,টিপু সাহেব আজ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। মামার দলভুক্ত যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে হয়ত এখনো কেউ না কেউ বেঁচে আছেন,সরকারের উচিত প্রকৃত যোদ্ধা যারা তাঁদের কাছ থেকে যুদ্ধ সম্পর্কে সত্য জানা, নইলে আসল সত্য
হারিয়ে যাবে। সুবিধা ভোগীরা সত্যকে গোপন করে গড়ানো মিথ্যা উন্মোচন করবে।
মা বড়ো হওয়াতে মামার সাথে যারা আসতেন, সকলের বু আমার মা। আর এই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অপরাধে মা আব্বা হয়ে উঠলেন রাজাকার পাকিস্তানী বাহিনীদের কাছে লিষ্টেড অপরাধী। দীর্ঘ নয়টি মাস এই অপরাধের দায়ে আব্বাকে বড়ো কাঠের বাক্স এর ভিতর কাটাতে হয়েছ। আব্বা ঐ নয়টি মাস শুধু রাতে একবেলা খেয়েছেন,প্রাকৃতিক কাজও সেরেছেন রাতে। আব্বার জীবন বাঁচানোর জন্য এটাই ছিলো একমাত্র রাস্তা। আব্বা মা এখনো বেঁচে আছেন মৃত্যু পথযাত্রী হয়ে। কিন্তু মামাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
মামা আপনাকে নিয়ে আমরা যেমন গর্ববোধ করি, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য আব্বা মাকে নিয়ে তাঁদের সন্তান হিসেবে গর্ব বোধ করি। মামা দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে বেহেশতের মেহমান বানিয়ে রাখুন। আর আব্বা মা যতটা দিন বেঁচে আাছেন ততদিন যাতে সহি সালামতের সহিত কাটাতে পারেন,সেটাই আল্লাহর কাছে একমাত্র চাওয়া।
লেখক,
শামছুন্নাহার,
একজন কবি ও সাহিত্যিক।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: