
শিষ্টাচার খারাপ হলে তার বেড়ে উঠা ও নিজের রুচিবোধ সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে। শাব্দিকভাবে মার্জিত, ভদ্র ও সুন্দর আচরণই শিষ্টাচার নামে পরিচিত। শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাকে সমার্থক গণ্য করা যায়। শিষ্টাচার ব্যক্তিগত গুন হলেও তা সমাজের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত কারণ অপরের সুবিধা-অসুবিধা, ন্যায়বিচার, মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই শিষ্টাচার ও সৌজন্যতার মূল উদ্দেশ্য।
মানুষের জীবন সুন্দর, সুশৃঙ্খল, পরিপাটি ও আদর্শিক করার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার এর গুরুত্ব অপরিসীম। আদর্শ ও জবাবদিহিমূলক সমাজ গঠনের জন্য শিষ্টাচার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যে জাতির মধ্যে যতবেশী শিষ্টাচার বিদ্যমান সে জাতি ততবেশী সভ্য ও উন্নত। নবি করিম হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন- "নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুওয়তের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ সমতুল্য।" বিশ্ব জগতে যারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন তারা এই শিষ্টাচার ও সুন্দর আচরণের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করেছেন। আমাদের প্রিয়নবি সাঃ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আল্লাহ্ বলেন - ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী (ক্বলম ৬৮/৪)। উন্নত ব্যবহারের জন্য ছোট বড় সকল শ্রেনীর মানুষের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন।
দায়িত্বশীল পর্যায়ে যদি ধর্মীয় অনুশাসন থাকে তাহলে সকল ক্ষেত্রেই শিষ্টাচারের ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। দায়িত্বশীল ব্যক্তির অশালীনমন্তব্য/ আচরণের কারনে রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যাহা কারোর কাম্য নয়। ভাল ব্যবহার ও সুসভ্য জাতি গঠনের সর্বোত্তম উপায় ও উপকরণ রয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে। আহার-পানীয় গ্রহণে, অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে, সালাম আদান-প্রদানে, অনুমতি গ্রহণে, ওঠাবসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ কিরূপ হবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। কোন মুসলিম কাঙ্ক্ষিত মানের ও সুসভ্য মানুষ রূপে গড়ে উঠবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতি অপেক্ষা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করতে সক্ষম হবে তখনই, যখন ইসলামী শিষ্টাচারের সুষমাকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পার্থিব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। তাই মানব জীবনে শিষ্টাচার অতি গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন দার্শনিক বলেন- ‘জ্ঞান-বুদ্ধি ছাড়া শিষ্টাচার হয় না; আর আদব ছাড়া জ্ঞানও হয় না’ অর্থাৎ একটি আরেকটির পরিপূরক।
রুওয়াইম ইবনু আহমাদ আল-বাগদাদী তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘তুমি তোমার আমলকে লবণ ভাববে, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা’ অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত অধিক গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম-বেশী হয়।" সুতরাং মানব জীবনে আদব শিষ্টাচার অতি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের দায়িত্বশীল পর্যায়ে যদি ইসলামিক নীতির অনুশাসন থাকে তবে সকল ক্ষেত্রেই শিষ্টাচারের প্রয়োগ করা সম্ভব । এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-"কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে,কেননা এটা তাকওয়ার নিকটবর্তী। "- সুরা আল মায়িদা : ৮ যারা শিষ্টাচার ও ন্যায়নীতির সাথে ক্ষমতা ও পদের ব্যবহার করেন পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরুষ্কার। তাই সর্বদা যেকোন পরিস্থিতিতে শিষ্টাচারের সহিত চলতে হবে তবেই আমরা সবাই সার্থক হবো এবং একই সাথে সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবন হবে সুন্দর ও পরিপূর্ণ। শিষ্টাচার/ নম্রতা সম্পর্কে বিভিন্ন বিখ্যাত/ বিশিষ্ট ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন- "নম্র ও কৃতজ্ঞ হওয়ার কারণে লোকেরা আপনাকে সাহায্য করার জন্য আরও ঝোঁক তৈরি করবে। এবং যদি লোকেরা আপনাকে সহায়তা করতে ইচ্ছুক থাকে তবে আপনি দুর্ঘটনাক্রমে আপনার পছন্দসই কিছু পেতে পারেন।" – জেসন সুদিকিস "ভালো ব্যবহার দ্বারা বন্ধু, এমনকি শত্রুরও মন জয় করে নেওয়া সম্ভব।"— চাণক্য। "ভালো মতবাদের জন্ম হয় সাধারণত ভালো ব্যবহার থেকে।"— জন স্টট। শিষ্টাচার সম্পন্ন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার চেষ্টা আমাদের ব্রত হওয়া উচিত। সুন্দর আচরণই শিষ্টাচারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। একটি সুন্দর কথা ভালো গাছের মতো, মাটিতে যার শিকড় বদ্ধমূল, আকাশে যার শাখা বিস্তৃত, যে গাছ অফুরন্ত ফল দান করে ও শুশীতল ছায়া প্রদান করে। তাই সুস্পষ্ট ভাষায় সুন্দরভাবে কথা বলতে হবে এবং যার মাধ্যমেই মানুষের পারিবারিক শিক্ষা ফুটে উঠে।
তাই আপনার সহপাঠী, সহকর্মী, যানবাহনে সহযাত্রী সহ ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষে সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। শিষ্টাচার তথা উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করার প্রচেষ্টা করতে হবে যাহাতে আমাদের ইহকাল ও পরকাল দুটোই শান্তির হয়।
লেখক, মোঃ তরিকুল ইসলাম টিপু

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: