বিশেষ প্রতিনিধি।।
যশোরের চৌগাছার জগদীশপুর ইউনিয়নের স্বর্পরাজপুর গ্রামের ছায়রন (৭৫) বছরের এক বৃদ্ধার ছেলেদের ফ্ল্যাটবাড়ি থাকা সত্ত্বেও ঘরে জায়গা হয়নি। বসবাস করেন দীর্ঘ ৫ বছর ধরে বাঁশঝাড়ের সারগর্তে। অসহায় বৃদ্ধা এই মায়ের পাশে দাঁড়ালেন ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৩৫ বছর আগে। স্বামী হারানোর পর অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে মানুষ করেছেন ৪ ছেলে ২ মেয়েকে। চার ছেলের তিনজন বর্তমানে জীবিত মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে। তারা যার যার মতো স্বাচ্ছন্দে বসবাস করেন। সবারই আছে ইটের (আধাপাকা) বাড়ি তবে কোন বাড়িতেই জায়গা হয়নি মায়ের। মেঝো ছেলে আনিছুর ফ্লাট বাড়ি তৈরি করছেন। বাড়িতে এসেছে ২/৩ গাড়ি চলতি মৌসুমের আমন ধান।
বৃদ্ধ মা’ এখন আর কাজ করতে পারেন না। অসহায় বৃদ্ধা এই মা মা’ ছেলেদের ঘরে জায়গায় না হওয়ার বসবাস করছেন বাঁশঝাড়ের গোবরের সারগর্তে গরু ও মানুষের মলমূত্রের মধ্যে একটি ঝুপড়িতে প্রায় পাঁচ বছর ধরে। তবে সেই ঝুপড়িও ছেলেরা তৈরি করে দেননি। নিজের জমানো কিছু টাকা ছিলো সেই টাকা দিয়ে ছেলেরা দু/তিনখানা টিন কিনে বাঁশের খুটির উপর বসিয়ে দিয়েছেন ঝুপড়ি। বাকি টাকাও ভাগ করে নিয়ে নিয়েছেন তাঁরা।
২৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বরত সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী কাফী বিন কবির এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ দুটি কম্বল, চাল, ডাল আলু ব্যক্তিগতভাবে একহাজার নগদ টাকা সহ খাবার নিয়ে হাজির হন বৃদ্ধা ছায়রন এর বাড়ি। সেখানে একটি কাঠের পিড়িতে ইউএনও বসে বৃদ্ধাকে চেয়ারে বসিয়ে কথা বলেন তাঁর সাথে। এবং বৃদ্ধার কাছে সবকিছু শুনে বড় ছেলের পাকা ঘরের বারান্দায় তুলে দেন বৃদ্ধাকে। এসময় ইউএনও
নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য শাহিনুর রহমানকে নির্দেশ দেন তিন ছেলেকে আগামী দুই দিনের মধ্যে ইউএনও অফিসে যেতে। এবং তিনি বৃদ্ধাকে প্রতিশ্রুতি দেন আপনাকে আর না খেয়ে এভাবে ঝুপড়িতে থাকতে হবে না।
স্বাক্ষাতের সময় বৃদ্ধা ছায়রন বলেন, সকালে গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও স্বর্পরাজপুর দাখিল মাদরাসার সুপার আম্মাদুল তাঁকে খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই খাবার ছাড়া দুপুর পর্যন্ত আর কিছু খাননি। তিনি ইউএনওর কাছে আরো অভিযোগ করেছেন ছেলে ও পুত্রবধূরা তাঁকে বাড়িতেই যেতে দেন না। মাঝেমাঝে খাবার দিয়ে যান। বিষয়টি গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জানলেও কোন প্রতিকার পাননি তিনি।
ইউএনও আসার খবর পেয়েই বাড়িতে তালা দিয়ে সড়ে পড়েন ছেলের বউরা। এবং আগে থেকেই মাঠে কাজ করায় বাড়িতে ছিলেননা বৃদ্ধার ছেলেরা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাফী বিন কবির ছেলেদের বিচার করার কথা বলতেই কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধা মহিলা। ইউএনওর হাত জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন ‘‘না না না সোনা ওদের ধরতি হবে না। ওরা জন মাইনে খেটে খাচ্ছে। ওদের কিছু বলো না বাপ।’’

ছায়রনের প্রতিবেশি আয়েশা জনান, স্বামীর মৃত্যুর সময় তাঁর ছোট ছেলের বয়স ছিল ৫ বছর সে ছেলে মারা গেছেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে তারা থাকেন স্বামীর ঘরে। মূলত ছেলে বউদের ঠেলাঠেলি ও নানান অভিযোগ তুলে বাঁশ ঝাড়ে গোবরের সারের গর্তের পাশে ময়লার মধ্যে তাঁকে রেখেছেন। ঝুপড়িটিও বৃদ্ধার নিজের কাজ করে জমানো টাকার। সেখান থেকেও টাকা নিয়ে নিয়েছেন ছেলেরা। দীর্ঘদিন ধরে বৃদ্ধা রোদবৃষ্টি ঝড়ে এই বাঁশ ঝড়েই থাকেন। কাথাবালিশে পেশাব-পায়খানা করে দিলেও ছেলে-বৌরা পরিস্কার করেন না। পাশের জগদীশপুর গ্রামের এক নারী এবং গ্রামের কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে পরিস্কার করে দেন এসব।
গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আম্মাদুল ইসলাম বলেন মা’র খাবার দেয়া বা ঘরে রাখার মত সক্ষমতা ছেলেদের আছে। তাঁর ছেলে ও নাতী যারা আছে তাঁরা প্রত্যেকে একদিন করে খেতে দিলেও এক সপ্তাহ হয়ে যায়। তবে ওদের বারবার বললেও তাঁরা কারও কথা শোনেন না।
এবিষয়ে ইউএনওর দায়িত্বপালনকারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাফী বিন কবির বলেন, এটা খুবই অমানবিক বিষয়। মা’কে এভাবে বাঁশঝাড়ে ময়লা আবর্জনার মধ্যে রাখার মত খারাপ অবস্থায় তাঁরা নেই। আমরা তাকে আপাতত কিছু খাবার, হাত খরচ ও দুটি কম্বল দিয়ে ছেলের ঘরে তুলে দিয়ে এসেছি। তাঁর ছেলেদের অফিসে আসতে বলা হয়েছে। তাঁদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: