মালয়েশিয়া থেকে আসছে মনিরামপুরে একের পর এক লাশ স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক

মণিরামপুর প্রতিনিধি।। | প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২৪ ১৩:০৬

মণিরামপুর প্রতিনিধি।।
প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২৪ ১৩:০৬

ফাইল ফটো

মনিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি।। প্রবাসে কাজ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া। সেখানে বহু নাগরিক নানা ক্ষেত্রে কর্মরত আছেন। শুধু যশোরের মনিরামপুর থেকেই গেছেন প্রায় ৩৫ হাজার কর্মী। তাদের পাঠানো ডলারে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সাম্প্রতিককালে ডলারের সঙ্গে আসছে লাশও বাড়ছে স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মৃত্যুর হার। দালালদের প্রতারণার শিকার ও অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোয় মানসিক চাপ থেকে স্ট্রোকে এই বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রাহকদের প্রাণ যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

গতকাল শনিবারও মালয়েশিয়া থেকে এসেছে এক প্রবাসীর লাশ। এ নিয়ে গত দেড় মাসে এসেছে পাঁচজনের মরদেহ। এর আগে ১ জুন আসে উপজেলার মুক্তারপুর গ্রামের আকবর আলীর ছেলে আবদুল খালেকের লাশ, ২ জুন খড়িঞ্চী গ্রামের ওমর আলী ফকিরের ছেলে আবু সাঈদ, ৩ জুন মুক্তারপুর গ্রামের মহির উদ্দিন ফকিরের ছেলে ইব্রাহিম হোসেন, ১২ জুন মাঝলাউড়ী গ্রামের সাইফুল্লাহর ছেলে মেহেদী হাসান শামীম ও ১৩ জুলাই ফিরেছে জালালপুর গ্রামের শামছুর রহমানের ছেলে ইকবাল হোসেনের নিথর দেহ। এর আগে মে মাসে মনিরামপুরের দুই প্রবাসীর লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে, যাদের মৃত্যু স্ট্রোকে হয়েছে বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।

মুক্তারপুর গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, 'আমার শ্যালক আবদুল খালেকের মৃত্যু হয় মালয়ে- শিয়ায়। সেখানে তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল বলে জানতে পেরেছি।' তাঁর মতো একই তথ্য দেন অপর নিহত প্রবাসীর স্বজনরা।

আবদুল কাদের জানান, মালয়েশিয়ায় মাসুম মারা যাওয়ার পর মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয় স্ট্রোক। হয়তো অতিরিক্ত কাজের চাপে তাঁর এ পরিণতি হয়। শ্যামকুড় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরু- জ্জামান জানান, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্যামকুড় গ্রামের মেহেদী হাসান নামে এক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

স্থানীয়রা বলছেন, বিদেশে ভালো বেতনে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ-যুবকদের ফাঁদে ফেলে দালালরা। ঋণ ধার করে, চড়া সুদে টাকা নিয়ে, আবার কেউ কেউ পরিবারের শেষ সম্বল বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা তুলে দেন এই প্রতারকদের হাতে। এর পর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর পর যখন জানতে পারেন যে, তারা বৈধভাবে প্রবাসে যাননি, তখন মাথায় বাজ পড়ে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে স্বাভাবি- কভাবে ফিরে আসার সুযোগও তাদের থাকে না। থাকলেও কেউ আসতে চান না। কারণ ফিরে এলে লাখ লাখ টাকার ধার-দেনা কীভাবে শোধ করবেন- সেই দুশ্চিন্তা ভর করে। এ ভয় থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন বহু রেমিট্যান্স যোদ্ধা।

প্রবাসীদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত মনিরামপুর প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি শরিফুল ইসলাম জানান, দেশটিতে বর্তমানে এ উপজেলার প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ অবস্থান করছেন। তাদের অধিকাংশই দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেছেন। সারাক্ষণ তাদের পুলিশের ভয় তাড়া করে, কাজ মেলে না। টুকটাক কাজ পেলেও কাগজপত্র ঠিক না থাকায় ঠিকমতো পারিশ্রমিক পান না। প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের আশঙ্কায়। এর ওপর থাকে পরিবার থেকে টাকা পাঠানোর তাগাদা। এসব কারণে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়ে গেছে। যার পরিণতিতেই হয়তো একের পর এক কর্মীর স্ট্রোকে মৃত্যু হচ্ছে। তিনি বলেন, মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত হয়। আইনি নানা প্রক্রিয়ায় লাশ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। সাম্প্রতিকালে অধিকাংশ রেমিট্যান্স যোদ্ধার মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্ট্রোকের কথা বলেছেন চিকিৎসকরা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর অভিযোগে দালালদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দেয়নি। লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে এ অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে দেশে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাঠানো

ডলারের চড়া মূল্য থাকলেও দাম নেই তাদের লাশের। বিভিন্ন দেশে মারা যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের মরদেহ সেখানে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। অর্থাভাবে গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা সাধরণত নেওয়া হয় না। আবার দেশে আসার পর বিমানবন্দরে আরেক দফা অবমাননার শিকার হন তারা। সেই লাশ পরিবহন করতেও সহজে পাওয়া যায় না যান। এমন প্রেক্ষাপটে অনন্য উদ্যোগ নিয়েছেন যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের সংসদ সদস্য ইয়াকুব আলীর ছোট ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের ডা. মেহেদী হাসান। 'আমাদের এ্যাম্বুলেন্স' নামে একটি ফ্রী লাশ বহন এম্বুলেন্স সেবা চালু করেছেন। সেই সেবার মাধ্যমে প্রবাসীদের মৃতদেহ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মনিরামপুরে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: