মোঃ শাহ্ জালাল।। খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ, গুড়, পাটালি, পিঠা তৈরি নিয়ে যশোর অঞ্চলের একটি বিখ্যাত লোকসঙ্গীত‘ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটতি যাবো'‘ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটতি যাবো, খাজুরগাছে চোমর বারোইছে তোরে আইনে দেবো, নস গুড় পাটালি বেঁচে গয়না গড়ে দেবো ...’।
শীত এলেই দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেনো, বাঙালির মনে পড়ে যায় যশোরের খেজুর রস, গুড়-পাটালি আর পিঠার কথা। কিন্তু বছরের পর বছর দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে পেটের দায়ে বেঁচে থাকার তাগিদে চৌকষ গাছিরা পেশা বদলে ফেলেছেন। স্বল্প কিছু খেজুরগাছ এখনো যশোরের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে। তবে শীত এলে সেগুলো থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছি পাওয়া দুষ্কর। ফলত রস তথা গুড়-পাটালির উৎপাদন কমেছে আশঙ্কাজনক। কিন্তু যশোরের গুড়-পাটালির চাহিদা থেকে গেছে আগের মতোই। এই সুযোগে কিছু অসাধু কারবারি খেজুড়গুড়ের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে দেদারছে বিক্রি করছে যশোরের গুড পাটালি বলে।
সরকারিভাবে যশোর জেলাকে যেভাবে ব্রান্ডিং করা হয়েছে, সেখানেও রয়েছে খেজুর গুড়ের কথা- ‘নানা রঙের ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ের যশোর জেলা’। এসব কারণেই যশোরের খেজুররস, গুড়-পাটালির পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে যশোরের উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন। এর মধ্যে মনিরামপুর মদনপুর কলেজে উদ্যোগে প্রতিবছর নতুন করে লাগানো হয় রাস্তার দুই পাশদিয়ে খেজুর গাছের চারা ও পালন করা হয় কলেজ প্রাঙ্গণে রস গুড়ের তৈরী পিঠা মেলার উৎসব। মদনপুর কলেজের প্রভাষক আব্দুস সালাম বলেন‘আমাদের জেলার প্রধান যে ঐতিহ্য খেজুরগাছের রস, গুড়, পাটালি, তাকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে প্রথমে আমরা একটি সমীক্ষা করি। আমরা দেখতেই পাই, এই ঐতিহ্যটি হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণটি হলো, খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের ব্যাপারটি বেশ কষ্টকর। নিপুণ দক্ষতা না থাকলে ভালো মানের রস-গুড়-পাটালি উৎপাদন করা যায় না। একসময় যেসব দক্ষ গাছি তাদের নিপুণ হাতে এই কাজটি করতেন, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আগে গাছিদের সন্তানরাই বাবার কাছ থেকে শিখে এই কাজ করতেন। এখন অন্যকাজে অল্প পরিশ্রমে বেশি টাকা আয়ের সুযোগ হওয়ায় গাছিদের সন্তানরা আর খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের কষ্টসাধ্য কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এ অবস্থায় যশোরের এ ঐতিহ্য বিলুপ্তির দিকে এগুচ্ছে।’
যশোর ডটকম নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ ও তাদের আইডি দিয়ে যশোরের ঐতিহ্য রস গুড়ের প্রচারে সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কারণ হিসেবে জানতে চাইলে ঐ গ্রুপের এক জন শিরিন সুলতানা বলেন 'আমাদের পরিকল্পনা, রস সংগ্রহ, গুড়-পাটালি তৈরির কাজকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করে তুলতে ও যশোর এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছর আমাদের রস গুড়ের পিঠা উৎসব পালব করে থাকি। তা না হলে কোনোভাবে নতুন প্রজন্মকে গাছ কাটা, রস-গুড় উৎপাদনে আগ্রহী করা যাবে না। কেবল স্থানীয় বাজারে গুড়-পাটালি বিক্রি করলে গাছিরা ভালো দাম পাবেন না। দরকার আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। আমরা ঠিক এই কাজটিই করছি। যশোরে উৎপাদিত গুড়-পাটালি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। গাছিরা যাতে ভালো দাম পান, সেই দিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছে। সকলের উচিত আমাদের এই কাজে সহযোগিতা করা এবং আমাদের যশোরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সহায়তা করা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: