জাহানারা মুক্তার লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারী ২০২১ ১৩:২৬

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারী ২০২১ ১৩:২৬

ছবি সমসাময়িক
মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি।। সমাজের প্রতিটি মানুষই সমান, থাকবেনা কোন শ্রেণি ভেদাভেদ-বৈষম্য, থাকবেনা কোন অন্যায়-অবিচার। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব পেশায় থেকে আত্ম-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে, এটা তার মৌলিক ও জন্মগত অধিকার। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই- ছোটবেলা থেকে মানুষের প্রতি এমনই সব আকুতি যার মনকে দোলা দিতো, অন্যায়-অনিয়ম যাকে কোনদিন স্পর্শ করেনি, আপোষ নেই যার জীবনের অভিধানে, কিশোরী বয়সেই হয়ে ওঠলেন প্রতিবাদী, যার জন্য কারাবন্দী হয়ে চরমমূল্য দিতে হলো তাঁকে। তিনি হলেন মণিরামপুর উপজেলার পানিছত্র গ্রামের গৃহবধূ জাহানারা মুক্তা। মণিরামপুর উপজেলা শহর থেকে পশ্চিম দিকে অন্ততঃ ৮কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পাওয়া গেল পানিছত্র গ্রাম। দিগন্তজোড়া মাঠ-খাল-বিল গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে। ঠিক বিলের কোল ঘেঁষে জাহানারা মুক্তার বাড়ি। বাড়িতে একাই থাকেন তিনি। তাঁকে বাড়িতে না পেয়ে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা গেল পার্শ্ববর্তী গোপীকান্তপুর গ্রামে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের নিয়ে উঠান বৈঠক করতে গেছেন। খবর পেয়ে ফিরে আসলেন বাড়িতে। তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলে আন্তরিকতার সাথে তা গ্রহন করে শোনাচ্ছিেিলন সংগ্রামী জীবনের গল্প- “১৯৫৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমার জন্ম। বাবা সাদেক আলী তরফদার ও মা আমেনা বেগমের আট ছেলে মেয়ের মধ্যে আমি বড়। পিতৃ পরিবার ঐতিহ্যবাহী হলেও আমাদের সময়ে দারুন অর্থ কষ্টে পড়তে হয়।যাকে বলে জীবন সংগ্রাম। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে শুধুমাত্র অর্থ কষ্টের কারণে নিজ উপজেলার শ্যামকুড় গ্রামে মামা মুনছুর আলীর বাড়িতে থেকে স্থানীয় শ্যামকুড় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকি। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম অসীম সাহসী ও দূরন্তপনা। মেধার দিক দিয়ে ক্লাসে প্রথম ছিলাম বরাবরই। বৈষম্য শব্দটি ছিল আমার জীবনের যেমন বড় অন্তরায়, তেমনি অধিকার শব্দটি আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের যেমন রয়েছে সম -মর্যাদা, তেমনি রয়েছে সমান অধিকার। সেই ব্রতকে মনন, মেধা ও বুকে ধারণ করি, লালন করি একটু বুঝতে শিখলে ধরে। এক পর্যায়ে ৬৮-৬৯ সালের দিকে পরিচয় হয় বাম রাজনৈতিক সংগঠনের অন্যতম নেতা কমরেড গাজী আব্দুল হামিদের সাথে। তাঁর অনুপ্রেরণা ও তাদের আদর্শ ও লক্ষ্য আমাকে দারুনভাবে আকৃষ্ট করে। যোগ দিই তাঁদের সেই আদর্শের সাথে, শ্রেণি সংগ্রামের আন্দোলনে। যার জন্য ১৯৭৫ সালে ১০ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হই। তিনমাস কারাভোগের পর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করি। এক একে পরিচয় ঘটে বাম রাজনৈতিক সংগঠনের প্রাণপুরুষ কমরেড আব্দুল হক, কমরেড হেমন্ত সরকার, কমরেড অমল সেনসহ অনেক নেতাদের সাথে। শ্রেণি বৈষম্যেকে খতম করে সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে নিজের জীবনকে সপে দিই একেবারে।সেই আন্দোলনের কাফেলায় পরিচয় ঘটে একই উপজেলার পানিছত্র গ্রামের বাসিন্দা বীরমুক্তিযোদ্ধা সামছুল হকের সাথে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনকে এ্গিয়ে নিতে ১৯৭৫ সালে ১০ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে করে জীবন সঙ্গী করি সামছুল হককে। সেই থেকে অদ্যাবধি সেই সংগ্রামী চেতনাকে বুকে ধারণ ও লালন করে চলেছি। বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, বাংলাদেশ ওর্য়ার্কাস পার্টি, বাংলাদেশ ক্ষেতমুজুর সমিতি, নারী মুক্তি সংসদসহ বাম রাজনৈতিক সংগঠনে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অন্ততঃ তিন মেয়াদে স্থানীয় চালুয়াহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে সরাসরি জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগনের সেবা করার চেষ্টা করেছি। স্থানীয় ঘিবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে সারাটি জীবন সক্রিয়ভাবে সম্পৃক রেখেছি নিজেকে। নারী শিক্ষা কেন্দ্র করে গড়ে তুলে অন্ততঃ কয়েকশ নারীকে অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কয়েকহাজার নারী ও পুরুষ শ্রমিককে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাফেলায় নিয়ে আসার কাজ অব্যাহত রেখেছি। লেখালেখি করি ছোটবেলা থেকেই। অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছি। সৃতিরা কথা বলে, প্রয়াত নক্ষত্রের অলো, স্বপ্নের বধূ জীবন, ১০০ পেশাজীবি নারীকে নিয়ে “নারী মুক্তির পাঠশালা, ১০০ নারী শ্রমিকের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে “সভ্যতার আত্ম বিলাস” প্রকাশিত বইগুলো পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আমাকে নানাভাবে সামাজিক স্বীকৃতি ও সংবর্ধিত করেছেন। গোপীকান্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃক জনাকীর্ন অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা আমাকে আরো অনুপ্রাণিত করেছে। বিবহিত জীবনে দুই মেধাবী ছেলের গর্বিত দম্পত্তি ছিলাম, ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারী রাজগঞ্জ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন অসাবধানতাবশতঃ বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ছোট ছেলে ফজলুল হককে এবং ২০০৬ সালে স্বামী সামছুল হককে হারায়। বড় ছেলে মইনুল হক ইংরাজীতে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে ঢাকাতে গমাধ্যমের সাথে কর্মরত আছে। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আমার অপছন্দ। একদিকে সন্তানের অকালমৃত্যু, অন্যদিকে স্বামীর পরিবার থেকে নানা বাধাঁ আমাকে সবসময় ব্যথিত করে তোলে। কুরে কুরে খায়। সমাজের মানুষ আমাকে তাদের ভালবাসায় সিক্ত করে রেখেছেন। সেই ভালবাসায় আমাকে সামনের দিকে চলতে সাহায্য করে। সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সুবিধা, অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার, শ্রেণি বৈষম্যকে দূর করে সম অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনই আমার জীবনের স্বপ্ন।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: