
মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি।।
বিফলতার মধ্যেই সফলতার মূল বীজ নিহিত থাকে- এ সত্যটি প্রমাণ করেছেন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মুন্সী খানপুর গ্রামের শিক্ষিত বেকার যুবক মাসুদুর রহমান সবুজ। একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে চাকুরীর পিছনে দৌঁড়ে বিফল হয়ে অবশেষে কৃষি খাতের মসলা জাতীয় ফসল চুঁই ঝাল চাষ করে নিজেকে যেমন স্বাবলম্বী করে তুলেছেন, তেমনি এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী করতে এক অনন্য উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এলাকার ১৩জন শিক্ষিত বেকার যুবককে সাথে নিয়ে খানপুর চুইঝাল প্রজেক্ট ও নার্সারী গড়ে তুলেছেন সবুজ। নিজ বাড়ি, পাড়া, মহল্লা গ্রাম পেরিয়ে একে একে সাতটি গ্রাম নিয়ে গড়ে তুলেছেন চুই ঝাল পল্লী। সদস্য সংখ্যা দাঁঁিড়য়েছে অন্ততঃ ৫০০জনে। নিজেদের স্বাবলম্বীতা ছাড়াও এলাকার নিরক্ষরতাদের স্বাক্ষরতায়, আর্তমানবতার সেবায় নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী কর্মকান্ডে নিয়োজিত রেখেছেন।
মনিরামপুর উপজেলা সদর থেকে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে দক্ষিণ দিকে অন্ততঃ ৫কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পাওয়া গেল সুন্দলপুর বাজার। ওই বাজারের পূর্ব দিকে অন্ততঃ ১ কিলোমিটার গিয়ে হরিহর নদীর কোল ঘেঁষেই পল্লী গ্রাম মুন্সীখানপুর। সবুজের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতেই ১০৫বছর বয়সী বাবা আনছার আলী বললেন, তাকে কি বাড়িতে পাওয়া যাবে? সেতো থাকে চুই বনে। সংবাদ পেয়েই চলে আসলেন সবুজ। তার সফলতার কথা জানতে চাইলে শোনালেন তিনি এভাবেই-
“১৯৯৩সালের ১২অক্টোবর জন্ম আমার। বাবা আনছার আলী মোড়ল ও মা জয়গুননেছার ৮ ছেলে মেয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট। কৃষক পরিবারে জন্ম আমার। কৃষিকাজ করতে করতে এক পর্যায়ে বাবা গড়ে তোলেন নার্সারী। সেই সুবাধে কৃষি ও নার্সারীর কাজ শিখেলিাম। ২০১০ সালে স্থানীয় ধলিগাতী মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করে নিজ পছন্দে সাতক্ষীরায় ৪ বছর মেয়াদী কৃষি ডিপ্লোমাতে ভর্তি হই। ২০১৪সালে কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীন হয়ে খুলনা এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে বিএজিএড-এ ভর্তি হয়ে ২০১৮সালে কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীন হই। সেই থেকে চাকুরীর জন্য চেষ্টা করে বিফল হই। অবশেষে মন স্থির করলাম বাবার পেশায় ফিরে যায়। আমাদের আছে অনেক গাছ গাছালী। সেই গাছে ৬হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে মসলা জাতীয় ফসল চুইঝাল চাষ শুরু করি। তিন বছরের মাথায় তা ৬লক্ষ টাকায় পরিনত হয়। এবার এলাকার ১৩জন শিক্ষিত যুবককে সাথে নিয়ে পাড়া, মহল্লা, গ্রাম ধরে গাছ ভাড়া নিয়ে চুই ঝাল চাষ শুরু করি। নিজ গ্রাম পেরিয়ে তা আজ অন্য ৭টি গ্রামে অন্ততঃ সাড়ে চার হাজার গাছে আবাদ হচ্ছে। এতে এগিয়ে এসছেন অন্ততঃ ৫শতাধিক নারী পুরুষ। খানপুর চুই ঝাল প্রজেক্ট ও নার্সারী নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। চুইঝাল একটি অপ্রচলিত মসলা জাতীয় অর্থকরী ফসল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এটি বেশি চাষ হয়ে থাকে। চুই লতা জাতীয় গাছ, এর কান্ড ধূসর বর্ণের ও পাতা পান পাতার মত সবুজ রংয়ের। এর কান্ডটি মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ও ছায়ামুক্ত উচুঁ জমিতে এটি চাষ করা হয়। বৈশাখ-জৈষ্ঠ অথবা আশ্বিন-কার্ত্তিক মাসে চুইয়ের পোঁড় (চুইয়ের কান্ডকে স্থানীয় ভাষায় পোঁড় বলে) রোপন করা হয়। চুই লতা জাতীয় গাছ বলে বাউনি হিসেবে আম, জাম, সুপারি, নারকেল ইত্যাদি গাছের গোড়ায় এটি রোপন করা হয়। পাহাড়ী, ভুইয়ে, দেশী বিভিন্ন জাতের আছে। আমরা দেশী জাতের চুইয়ের আবাদ করছি। এক বছর বয়সী চুই খাওয়া যায়, তবে ৫/৬ বছরের চুই উত্তম। এটি স্থানীয় বাজার ছাড়াও যশোর, খুলনা, ঢাকাসহ দেশ-বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতি কেজি চুই ৫০০-৮০০টাকা দরে বিক্রি করা যায়। সবুজ বলেন, আত্ম-নির্ভরশীল হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরকেও উঃসাহিত করে দারিদ্রমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে অংশ নেওয়ায় আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মহান সৃষ্টিকর্তা আমার সে স্বপ্ন সফল করবেনই।
সবুজের প্রতিবেশী অধ্যাপক আব্দুল হালিম বলেন, সবুজ বেকার যুবকদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইউনানী ও আয়ুবের্দীয় হাকীম হাফেজ আবদুল¬াহ আল হারুন বলেন,অত্যন্ত মুখোরোচক, শ্লেø¬ষ্মা ও ব্যাথা নাশক এবং হজমীকারক ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ লতা জাতীয় গাছ হলো চুই। মসলা হিসেবে মাংস ও মাছ রান্নায় এটির ব্যবহারের কোন জুড়ি নেই। মণিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসার হীরক কুমার সরকার বলেন, চুই ঝাল ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ মসলা জাতীয় ফসল । এটি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিহীন স্বল্প ব্যয়ে চাষ করা যায়। চুইয়ের আবাদ করে দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন করা সম্ভব । সবুজ চুই ঝাল চাষ করে আত্ম-নির্ভরশীল হয়েছেন এবং অন্যদেরকে উৎসাহিত করছেন। তিনি বেকার যুবকদের জন্য একটি মডেল।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: