এখনও ঘোচেনি নারী-পুরুষের পারিশ্রমিক বৈষম্য পুরুষদের মতো বাংলাদেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রসহ নানা বিষয়ে এগিয়ে থাকলেও পুরুষদের তুলনায় পারিশ্রমিকে পিছিয়ে নারীরা। যদিও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও তা এখনও শতভাগ বাস্তবায়িত হয়নি নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। শ্রমিকদের অভিযোগ বর্তমানে সব কিছুর মূল্য অনুযায়ী তারা তাদের অধিকার ও ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। এতে চরম কষ্টে জীবন যাপন করতে হচ্ছে মনিরামপুর শ্রমিকদের।
মনিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, একই কর্মঘন্টা ও সমান পরিশ্রম করেও পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকদের মজুরিতে বৈষম্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নির্মাণ থেকে শুরু করে মাঠে ঘাটে কাজ করা নারী শ্রমিকদের পারিশ্রমিক তুলনামূলক ভাবে কম।
রোদে শরীরের ঘাম ঝড়িয়ে ইট ভাটার একজন নারী সারাদিন কাজ করে পান মাত্র দুই টাকা। অন্যদিকে পুরুষরা কাজ ভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন। এছাড়া মাঠে ঘাটে একই কাজ করে একজন পুরুষ পান ৩৫০ টাকা ও একজন নারী পান ৩০০ টাকা মজুরি। সংসারের ভারে উপায়ন্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে নারীদের।
নারী শ্রমিকরা বলছেন, নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা শুধু মুখে বললেই হবে না সরকারকে শতভাগ বাস্তবায়িত করার দাবি ও অনুরোধ জানান তারা।
সানজিদা ইয়াসমিন নামে এক নারী শ্রমিক ভুট্টার ক্ষেতে বীজ বপনের কাজ করছিলেন তিনি বলেন,‘স্বাধীন বাংলাদেশে নারী পুরুষের সমান অধিকার কথা সরকার বললেও নারীরা সমান অধিকার পাচ্ছি না। এই যে আমার কয়েকজন নারী একসঙ্গে ভুট্টার ক্ষেতে কাজ করছি সারাদিন কাজ করে পাই ৩০০ টাকা। আমাদের সঙ্গেই কাজ করছেন একজন পুরুষ তিনি দিনে ৩৫০ টাকা মজুরি পান। অথচ আমরা পুরুষদের সমান কাজ করি তাও আমাদের মজুরি কম। প্রতিবছরে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমরা শুধু চিৎকার করি ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কিন্তু আমাদের এই কথা কেউ শুনে না। এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ দাবিগুলো আদায় হয়নি।,
রাহিমা বেগম নামে এক বৃদ্ধা শ্রমিক বলেন,‘পুরুষের থেকে কাজ বেশি করেও নারীরা মজুরি পাই কম। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম অনেক ৩০০ টাকা মজুরিতে ঠিকমতো সংসার খরচ হয় না। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ দিতে পারি না।,
কাসিরন নামের আরেক নারী শ্রমিক বলেন,‘আমরা তো নারী পুরুষের সমান অধিকার চাই কিন্তু পাই না। তাই প্রধান উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ করছি যাতে তিনি আমাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন।
উপজেলার মনিরামপুর সদর ইউনিয়নের ইটভাটার শ্রমিক ফাতেমা বলেন,‘সারাদিন কষ্ট করে কাজ করে পাই মাত্র ২০০ টাকা আর পুরুষরা পায় ২৫০-৩০০ টাকা। মালিককে আমাদের মজুরি বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও বাড়ায় না। কি করবো আমরা তো গরিব মানুষ তাই এই পারিশ্রমিকেই কাজ করতে হচ্ছে।,
অন্যদিকে পুরুষ শ্রমিকদের অভিযোগ বর্তমান দ্রব্যমূল্যের দাম অনুযায়ী তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার আগে যা মজুরি পেতেন এখনও তাই পাচ্ছেন।
কামালপুর গ্রামের আজিজুল হোসেন নামে এক রড মিস্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে সারাদিনে কাজ করে যা পাই তাই দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদি দ্রব্যমূল্য অনুযায়ী আমাদের মজুরিও বাড়ানো হতো তাহলে আমাদের আর এতো কষ্ট হতো না।,
পিলার তৈরির কারখানায় কাজ করেন কাশেম । তিনি বলেন,‘আগে একটা পিলার তৈরি করে পেতাম ২৫ টাকা এখনও সেটাই পাই। জিনিসপত্রের দাম তো বাড়ছে অনেক কিন্তু আমাদের কাজের মজুরি বাড়েনি। আমাদের মজুরি বাড়ানোর জন্য সরকার যদি আমাদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দিত তাহলে আমরা খুব উপকৃত হতাম।,
তাই মালিক ও সরকারকে দ্রব্যমূল্যের বাজার অনুযায়ী তাদের পারিশ্রমিক বাড়ানো ও নারী শ্রমিকদের সমান মজুরি দেওয়ার দাবি জানান ইটভাটার শ্রমিক মো. মোকবুল ইসলাম। কিন্তু মালিক পক্ষের লোকজন বলেছেন, নারী ও পুরুষদের কাজ অনুযায়ী মজুরি কম বেশি দেওয়া হয় এখানে বৈষম্যের কিছু নেই।
পুরুষদের থেকে নারীদের মজুরি কমের বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরামপুর সদর ইউনিয়নের দেবীদাসপুর গ্রামের MASB ব্রিকসের ম্যানেজার বলেন,‘পুরুষ ও নারীদের কাজ কখনোই সমান হতে পারেনা। তাই কাজ ভেদে দৈনিক হাজিরা নারীদের ২০০-২২০ টাকা ও পুরুষদের ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। এক হাজার ইট তৈরি করলে নারী শ্রমিক পান ৫২০ টাকা ও পুরুষ শ্রমিক পান ৫৯০ টাকা। ইট সাজানোর জন্য একজন নারী শ্রমিক পান হাজার প্রতি ১৭৫ টাকা পুরুষ শ্রমিক পান ১৮৩ টাকা। আমরা সরকারের সাথে সংগতি রেখেই কাজ করাছি। এখানে বৈষম্যের কিছু নাই।,
জেলার শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিক আন্দোলন আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকরা আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার ও পারিশ্রমিক আদায় করতে পারেননি। তাই এবিষয়ে সরকারের উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।
জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরী, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমরা শ্রমিক দিবস পালন করি ঠিকই ও স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারিনি। আমরা আন্দোলন সংগ্রামে গেলে মালিক পক্ষ আমাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে।,
তিনি আরও বলেন,‘পণ্যবাহি একটি ট্রাক ঢাকা নিয়ে যেতে ও আসতে একজন চালক পাই ২৫০০ টাকা সময় লাগে ৪ দিন। চালকের সাথে আবার একজন সহকারি থাকেন। তাকে ১ হাজার টাকা দিলে চালকের থাকে ১৫০০ টাকা। ৪ দিন পরিশ্রম করে বর্তমান দিনে দেড়হাজার টাকা দিয়ে আমাদের কিছুই হয় না। ঢাকা আপডাউনে কমপক্ষে ৬ হাজার টাকা পারিশ্রমিক লাগে। তাহলে আমরা কেমন করে ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছি?। আমাদের কথা কেউ কর্ণপাতও করে না। তাই সরকারের উপদেষ্টাদের বিনীত অনুরোধ করছি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য।,
উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত তামান্না বলেন, নারী ও পুরুষ উভয়েই সমান পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রাখে। তবে মনিরামপুর উপজেলাতে এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ আসেনি তার পরে-ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে যদি কোন ব্যতয় ঘটে, সম অধিকারের ভিত্তিতে নারীরা যদি পুরুষদের সমান পারিশ্রমিক না পান তাহলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
                                
                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: