আলমগীর ও সরাফাতের কারসাজিতে সাউথইস্ট ব্যাংকের আমানতকারীদের ভবিষ্যৎ শঙ্কায়

বিশেষ প্রতিনিধি।। | প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০৫

বিশেষ প্রতিনিধি।।
প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০৫

ফাইল ফটো

স্টাফ রিপোর্টার।। দুইজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক। একজন খোদ সাউথইস্ট ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। অপরজন পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই রয়েছে আর্থিক দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি, পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি ও অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগ। আলমগীর কবির অতি সম্প্রতি চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে সঙ্গে নিয়ে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাংকটির অন্যান্য পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বড় একটা অংশ। এতে আমানতকারীদের ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আলমগীর কবির, নাফিজ সরাফতের প্রতিষ্ঠান সিঙ্গেল ক্লিক আইটি সলিউশনস এবং আলমগীর কবিরের দুর্নীতির সহযোগী এশিয়া ইন্সুরেন্সকে দ্রুত সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যাংকটিকে রক্ষার জন্য আমানতকারী ও শেয়ার হোল্ডাররা দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চলতি বছরেই অ্যাক্টিভিস্ট ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলো উল্লেখ করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠান। বিষয়টি তদন্তের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরকেও পাঠানো হয়। কিন্তু আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালে আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়াম্যানের দায়িত্বে আসেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-নীতির ফাঁক গলে টানা ২০ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। এই সময়ে স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় ও নানান অনিয়মের মাধ্যমে অন্য পরিচালক ও ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেন। চলতি ঋণের সুদ মওকুফ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন এবং ঘটাচ্ছেন।
অপরদিকে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ১৯৯৯ সালে চাকরিজীবন শুরু করেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৪ বছরে ব্যাংক, পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ আরও কিছু খাতে রহস্যজনকভাবে প্রভাবশালী ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেন তিনি। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে পদ্মা ব্যাংককে দেউলিয়া করার পর নাফিজ সরাফাতের চোখ পড়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের দিকে।
একই সময়ে আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকে তার নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে নাফিজ সরাফাতের শরণাপন্ন হন। আলমগীর কবির ও নাফিজ সরাফাত আ.লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের সহায়তায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং একই সঙ্গে ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ কাশেম, প্রাক্তন চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ ও পরিচালক রেহানা রহমানের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাদেরকে ব্যাংকটির পর্ষদ পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা হয়। পরে সময়ে কৌশলে নাফিজ সরাফাত তার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গেল ক্লিক আইটি সলিউশনস-এর মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদকে ব্যাংকটির পরিচালক বানান। তিনি তার ১৮ বছর বয়সী ছেলে চৌধুরী রাহিব সরাফাতকেও ব্যাংকটির পরিচালক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকায় সেটি আর সম্ভব হয়নি।
আলমগীর কবিরের বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারির সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে যখন তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকের অর্থে তার ছেলে রাইয়ান কবিরকে সাউথইস্ট ব্যাংকেরই একজন পরিচালক বানান। আলমগীর কবির প্রথমে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের নামে ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে নেন। লিজিং কোম্পানিটি তার সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক বিএলআই ক্যাপিটাল-এর কার্যকরী মূলধনের প্রয়োজন মেটাতে ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু এখানে একটি স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। এতে বিএলআই ক্যাপিটালের মূল কোম্পানি, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে পর্ষদে ছিল। এ ক্ষেত্রে ঋণ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতির প্রয়োজন থাকলেও তা নেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, আলমগীর কবিরের স্ত্রী এবং রাইয়ান কবিরের মা সুরাইয়া বেগম বে লিজিংয়ের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। অধিকন্তু, পর্যাপ্ত জামানত এবং যথাযথ বন্ধক ছাড়াই ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল। ঋণের অর্থের একটি অংশ একটি ব্রোকারেজ হাউসে রাইয়ান কবিরের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্টে পাঁচটি পে অর্ডারের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়েছিল। যা তহবিল অপসারণের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি অপরাধ। রাইয়ান কবির সেই স্থানান্তরিত অর্থ হতে ২৫ কোটি টাকা মূল্যের সাউথইস্ট ব্যাংকের ২% শেয়ার ক্রয় করেন এবং ২০২০ সালের অক্টোবরে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হন। অর্থাৎ চরম ও বেপরোয়া আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে রাইয়ান কবির সাউথইস্ট ব্যাংকেরই অর্থে সাউথইস্ট ব্যাংক-এর পরিচালক হয়েছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাইয়ান কবিরকে সাউথইস্ট ব্যাংক পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। তবে জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং আইন লঙ্ঘনের দায়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আলমগীর কবির ও তার পুত্র রাইয়ান কবিরের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আলমগীর কবিরের ঋণ কেলেঙ্কারির অপর বৃহৎ উদাহরণ হলো নিজ স্বার্থে ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে কেয়া গ্রুপকে উদারভাবে অর্থায়ন করা যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ১,৫৫৪ কোটি টাকায়। কেয়া গ্রুপ গত বছর থেকে ঋণ শোধের কিস্তি পরিশোধ না করায় বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংক মূলধন ক্ষয়ের ঝুঁকিতে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করা হলেও উত্তর দেননি। পরবর্তীকালে ব্যাংকটির প্রধান কর্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া ব্যাংকটির জনসংযোগ কর্মকর্তা তানভীরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়ন




আপনার মূল্যবান মতামত দিন: