মুড়ি বিক্রি করে চলছে না সংসার, যাচ্ছেন অন্য পেশায়

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০২২ ১২:৩৮

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০২২ ১২:৩৮

ছবি সমসাময়িক

ছবি সমসাময়িক

মোঃ মানছুর রহমান (জাহিদ)।।

মুড়ি গ্রাম নামে পরিচিত বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার প্রত্যন্ত বারুইখালি গ্রাম। কাগজে-কলমে গ্রামের নাম বারুইখালি হলেও স্থানীয় ও আশপাশের এলাকার লোকজন এলাকাটিকে মুড়ি গ্রামই বলে থাকেন। কারণ এক সময় এই গ্রামের প্রায় সব পরিবার জড়িত ছিল মুড়ি উৎপাদনের সঙ্গে। গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যেত ছোট-বড় বিভিন্ন কড়াইতে চলছে মুড়ি ভাজা। এই মুড়িই চলে যাচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। আর এর মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে শতাধিক পরিবারের। কিন্তু সে চিত্র আজ অতীত। এক দিকে উৎপাদনে খরচ বেশি কিন্তু দাম কম পাওয়া, অপরদিকে প্যাকেটজাত মুড়ির বাজার দখলের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে মুড়ির কারিগররা। মুড়ি বিক্রির টাকায় সংসার না চলায় দিনে দিনে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে যাদের পেশা পরিবর্তনের সুযোগ নেই তারা বাধ্য হয়ে এখনও মুড়ি ভেজে চলছেন। এ অবস্থায় সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বাজারজাতকরণে সহযোগিতার মাধ্যমে হাতে ভাজা মুড়ির ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।প্রায় তিন যুগ ধরে মুড়ি ভাজা পেশার সঙ্গে জড়িত ষাটোর্ধ্ব কমল চন্দ্র সাহা। সম্প্রতি ছেলেকে ভ্যান কিনে দিয়েছেন। কারণ মুড়ি বিক্রির আয়ে তিন বেলা দু-মুঠো খাবার জুটছে না এখন আর। অথচ বছর দশেক আগেও পরিবার-পরিজন নিয়ে এই মুড়ি বিক্রির অর্থেই বেশ সুখে-শান্তিতে দিন কাটত তার।কমল চন্দ্র সাহা বলেন, আমাদের এলাকার বেশিরবাগ বাড়িতে মুড়ি তৈরি হতো। কিন্তু দিনে দিনে সে সংখ্যা শুধু কমছে। মুড়ির আয়ে সংসার না চলায় অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছে। মুড়ি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণের দাম বাড়লেও মুড়ির দাম বাড়েনি।গত ৪-৫ বছরে অন্তত ৫০টি পরিবার মুড়ি ভাজা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ১৫০০ টাকায় এক মণ মোটা ধান কিনতে হয়। এই ধান প্রক্রিয়াজাত, সিদ্ধ, শুকানো ও মিলে নিয়ে ভাঙিয়ে চাল বানাতে আরও ২০০ টাকা ব্যয় হয়। সেই চাল লবণ পানি দিয়ে ভিজিয়ে এবং গরম বালুর মধ্যে নাড়িয়ে মুড়ি তৈরি হয়। এক মণ ধানে ২৪ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ি তৈরিতে ব্যয় হয় ৭৫ টাকা। সব কাজ শেষ করে ভ্যানে করে বাজারে নিয়ে পাইকারি ৯০ ও খুচরা ১০০ টাকা কেজি দরে মুড়ি বিক্রি করি। এত কষ্ট করে যে দাম পাই তাতে আমাদের সংসার চলে না। তাই ছেলেকে ভ্যান কিনে দিয়েছি।শীলা রানী সাহা নামে এক নারী বলেন, ফজরের আজানের সময় থেকে এক টানা ৪-৫ ঘণ্টা চুলার পাশে বসে মুড়ি ভাজি। মুড়ি ভাজাই আমাদের একমাত্র পেশা। চুলার প্রচণ্ড তাপে আমাদের খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এত কষ্টের পরও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয় না। কোনোমতো খেয়ে-না খেয়ে বেঁচে আছি। কৃষ্ণ কান্ত সাহা নামে অপর এক মুড়ি তৈরির কারিগর বলেন, ছোটবেলা থেকে পারিবারিক পেশা হিসেবে মুড়ি ভাজি এবং বিক্রি করি। আগে সপ্তাহে দুই হাটে ১০ মণ মুড়ি বিক্রি করতাম। যে আয় হতো তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে যেত। কিন্তু দুই বছর ধরে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মুড়ির দাম বাড়েনি। অন্যদিকে মেশিনের মুড়ি বের হওয়ার পরে আমাদের হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা অনেক কমে গেছে। এখন সপ্তাহে পাঁচ মণের বেশি মুড়ি বিক্রি করতে পারি না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই এখন এই কাজ করি।স্থানীয় সুবল কৃষ্ণ সাহা বলেন, আগে মুড়ির ব্যবসা করতাম। এখন বাদ দিয়েছি। কারণ ধানের দাম বেশি, আবার আমাদের মুড়ির দাম ও চাহিদাও আগের মতো নেই। এছাড়া মেশিনে ভাজা প্যাকেটজাত মুড়ি বের হওয়ায় আমরা তাল মেলাতে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পেলেও আমাদের মুড়ির দাম বাড়েনি। তাই বাধ্য হয়ে মুড়ি ভাজা ছেড়ে ভ্যান চালানো শুরু করেছি। শুধু সুবল নয়, বারুইখালি এলাকার অনেক পরিবার মুড়ি ভাজা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।স্থানীয় ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সঞ্জিব সাহা বলেন, মূলত আর্থিক সংকটের কারণে আমাদের এলাকার মুড়ির কারিগররা পেশা পরিবর্তন করছেন। দিনে দিনে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে ভাজা মুড়ির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান তিনি।কচুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কে এম শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ধরনের কেমিকেল ছাড়া মোটা ধান দিয়ে বারুইখালি গ্রামের কৃষকরা মুড়ি তৈরি করেন। তবে বাজারে প্যাকেটজাত মুড়ির কারণে হাতে তৈরি মুড়ির চাহিদা কমে গেছে। আবার মোটা ধানের দামও বেড়েছে।তবে কৃষকদের সমস্যা সমাধানে স্থানীয়ভাবে মোটা ধানের চাষ বৃদ্ধি এবং হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অর্গানিক খাদ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষকদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা। কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা সরোয়ার বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসারের জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। হাতে ভাজা মুড়ি কচুয়ার একটি ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা কাজ করব। এক্ষেত্রে মুড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িতরা সরকারি বিভিন্ন দফতরে আবেদন করলে ঋণ প্রদানসহ অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।


undefined

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: