মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের এইদিনে মাগুরা-ঝিনাইদহের সীমা্ন্তবর্তী কামান্না গ্রামে একই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ২৯ জনকে হত্যা করে। সেই ভয়াবহ নিসংসতা সাক্ষী হয়ে আছে মাগুরাবাসী, এই বেদনার দিনে শহীদ পরিবারের প্রতি জানায় গভীর শ্রদ্ধা।
৭১ এর রণাঙ্গানের শহীদ ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধার বেশিরভাগের বাড়িই ছিল তৎকালীন মাগুরা মহকুমার সদর থানার হাজীপুর ইউনিয়নের হাজীপুর, শ্রীমন্তপুর, আরালিয়া, হ্নদয়পুর, ফুলবাড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে। যা "কামান্না যুদ্ধ" নামে আজো স্মৃতিবিজড়িত হয়ে আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালে কামান্না যুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেকে ছিলেন স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হাজীপুরবাহিনী এবং বিভিন্ন গেরিলা দলের সক্রিয় সদস্য।
ঘটনাপ্রবাহঃ
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর। তখনি আলো ফুটেনি ভোরের কুয়াশা ভেদ করে। এরমধ্যে মাগুরার কামান্না গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যায় গুলির শব্দে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে গুলির শব্দ এ গ্রামের মানষের কাছে একেবারে নতুন কিছু নয়।
সেখানে মাঝে মাঝেই গুলির শব্দ হয়।
তবে একটু পরেই তারা শুনতে পান দুদিক থেকেই গুলির শব্দ হচ্ছে।
আতঙ্কিত মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে একদল মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে।
আগের রাতেই মাগুরার হাজীপুর ও শ্রীমন্তপুর এলাকা থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে গিয়ে মাধব কুন্ডুর বাড়ির পরিত্যাক্ত বিশাল টিনের ঘরে অবস্থান নেয়।
তারা একটি অপারেশনে যাচ্ছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা কীভাবে যেন জেনে যায় রাজাকাররা।
রাজকারদের কাছ থেকে সেই খবর যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে।
হানাদার বাহিনী ভোর রাতেই হামলা চালায় কামান্না গ্রামে।
তখন ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা ছিল গভীর ঘুমের ঘোরে।
হামলায় প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা দিশেহারা হয়ে গেলেও পরে তারা পাল্টা গুলি ছুঁড়েও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রবল গুলি বর্ষণের মুখে সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে।
দীর্ঘ সময় ধরে মরণপণ লড়াইয়ে কামান্না গ্রামের মাটিতেই লুটিয়ে পড়েন বাংলা মায়ের ২৭ দামাল-সন্তান।
এদের সবাইর বাড়িই মাগুরার হাজীপুর এলাকায়।
এরা হলেন-
আলমগীর মৃধা, আব্দুল মতলেব, আলী হোসেন, কাদের বিশ্বাস, মোমিন উদ্দিন, ওয়াহেদুজ্জামান, রিয়াদ মন্ডল, শরীফুল ইসলাম, মুন্সি আলিউজ্জামান (ওরফে আরিফ মুন্সি), আজিজ, আকবর, মনিরুজ্জামান খান (ওরফে মনি খাঁ), মাছিম মিয়া, মুন্সি রাজ্জাক (ওরফে রাজা), শহিদুল ইসলাম, সলেমান শিকদার, মো: আব্দুর রাজ্জাক, গোলাম কাওছার মোল্লা, আব্দুস সালেক মোল্লা, সেলিম, হোসেন আলী (ওরফে আবুল হোসেন বিশ্বাস), খন্দকার রাশেদ হোসেন, গোলজার খাঁ, তাজরুল ইসলাম (ওরফে তাজু), আনিসুর রহমান আনিস, গৌর চন্দ্র রায় ও অধীর কুমার সিকদার।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চলে যাবার পর অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা এলাকাবাসীদের সহায়তায় কামান্না স্কুল মাঠের পাশে নদীর ধারে ৫টি গণকবরে এ শহীদদের সমাহিত করেন।
মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর গ্রামে সরকারি অর্থ ব্যায়ে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
তাই আজো প্রতি বছর কামান্না দিবস, বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতি সৌধে পুষ্পস্তবক দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা এ শহীদদের প্রতি তাদের ভালবাসা-শ্রদ্ধা জানান গ্রামের মানুষেরা।
আজকের এই দিনে কামান্না যুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ‘দৈনিক সমসাময়িক’ পরিবারের গভীর শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলী।