03/17/2025 আলোচিত কথা সাহিত্যিক অলিয়ার রহমানের লেখা ছোট গল্প- আলো আর আঁধারের রূপ
নিজস্ব প্রতিবেদক
৮ আগস্ট ২০২১ ১৪:১৮
ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনের ঘরটিতে প্রায় শ'খানেক লোকের সাথে বসে আছে সুমাইয়া। ঘরটিতে এসি চলছে - তবুও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে তার। চাকরিটা তার হবে তো? সে কি তার সমস্যার কথাটা ওনাদের বুঝিয়ে বলতে পারবে? সেই সকাল ছয়টায় এক গ্লাস পানি খেয়ে হাতে মাত্র দুইশো টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো সুমাইয়া। গাজীপুর পৌঁছাতেই একশো সত্তর টাকা খরচ হয়ে গেছে। সকাল এগারোটা বেজে গেছে - পেটে কোন দানা পানি পড়েনি। ওর বান্ধবী দীপান্বিতাকে বারবার বলে এসেছিলো ওকে তিন’শ টাকা বিকাশ করার জন্য। এখনো কোন টাকা বিকাশে আসেনি। আগেও অনেক বার ওর কাছ থেকে টাকা ধার করেছে সুমাইয়া। কোন টাকাই ফেরত দিতে পারেনি সে। ওর কাছে পুনরায় টাকা চাইতে দম বন্ধ হয়ে আসে সুমাইয়ার। কিন্তু উপায় নেই। আরও একবার লজ্জার মাথা খেয়ে টাকা চেয়েছে সুমাইয়া। দীপান্বিতা বলেছিলো পাঠাবে, কিন্তু যদি না পাঠায়? সে গাজীপুর থেকে ফিরে যাবে কিভাবে?
" আপনাদের মাঝে সুমাইয়া নাজনীন কে আছেন?" সুমাইয়া উঠে দাঁড়ালো। "জ্বি আমি।" " প্লিজ ভিতরে আসুন।" সুমাইয়া ভিতরে গেল। ইন্টারভ্যু' বোর্ডে মাত্র দুইজন লোক - দুইজনই মধ্যবয়স্ক। সে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে ইশারা করে বসতে বলা হলো। " আপনার নাম সুমাইয়া নাজনীন। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে অনার্স করেছেন।" "জ্বি স্যার।" " আমরা কিন্তু পত্রিকায় 'ফুড কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসারের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করেছে এমন লোকই আমরা খুঁজছি। " আমি স্যার আপনাদের প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার পরে এবিষয়ে প্রচুর পড়ালেখা করেছি। আপনি স্যার আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন। " ছাব্বিশ দিনে যদি পুষ্টিবিদ হওয়া যায়- তাহলে মানুষ চার বছর ধরে পড়বে কেন?" " আমি পারবো স্যার।" " আমরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে থাই, কোরিয়ান এবং কিছু কিছু চায়নিজ ফুড ফ্রোজেন করে বাজারজাত করে থাকি। আপনি কি বলতে পারবেন - সামুদ্রিক মাছ ফ্রোজেন করে রাখলে কতদিন পর্যন্ত তার পুষ্টিমান অক্ষুণ্ণ থাকে?" " পারবোনা স্যার।" " সুমাইয়া, আমরা বরং এই ইস্যু নিয়ে আর সামনে না এগোয়। আপনার জন্য শুভকামনা রইলো। ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে নিশ্চয়। Best of luck. সুমাইয়া ইন্টারভ্যু বোর্ড থেকে বের হয়ে বাইরে চলে এলো। প্রচন্ড পানি পিপাসা লেগেছে তার। সে পনের টাকা দিয়ে একটা পানি কিনে একদমে শেষ করে ফেললো। মোবাইলটা চেক করলো - কোন টাকা আসেনি। অবশ্য হাতে এখনো সময় আছে তার । এই কোম্পানির ফার্মাসিটিক্যাল বিভাগে আরও একটা ইন্টারভ্যু আছে বিকাল তিনটায়। ক্লিনারের চাকরি। শিক্ষাগত যোগ্যতা চেয়েছে কমপক্ষে বি এ পাশ। ঔষধ ফ্যাক্টরির ভিতরে কি সব কাজ করতে হবে। তার একটা চাকরি দরকার - কি কাজ সেটা দেখার সময় তার আজ আর নেই। সে ভয়ে ভয়ে একটা ফোন দিলো দীপান্বিতাকে। ওর ফোন বন্ধ। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল সুমাইয়ার। দীপান্বিতা যদি টাকা না পাঠায়? চোখ ফেটে কান্না আসছে তার। বন্ধুদের কেউ তার ফোন এখন আর রিসিভ করে না। কেমন যেন বমি বমি লাগছে তার। একটা চল্লিশ বাজে। সুমাইয়া পুনরায় "বন্ধু ফার্মা এ্যান্ড ফুডস্ এর অফিসে এসে বসলো। প্রথম পর্বের ইন্টারভ্যু শেষ হয়েছে। তিনটার সময় ফার্মাসিটিক্যালের ইন্টারভ্যু হবার কথা। এরই মধ্যে পুনরায় রুমটা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এদের সবার হয়তো চাকরির দরকার - কিন্তু তার মতো কি দরকার? তার বাবার ডায়ালাইসিসের ডেট ছিলো গতকাল, টাকার অভাবে সেটা করতে পারেনি। বাবার কষ্ট চোখে দেখা যায় না। গতকাল রাতে সামান্য রুটি আর কলা কিনে নিয়ে গিয়েছিলো বাসায়- সকালের নাস্তার জন্য। আজ দুপুরে বাসায় রান্না হয়নি। রাতে চাল ডাল কিনে নিয়ে গেলেই তবে রান্না হবে বাসায়। ওদের কি আমার মতো অবস্থা? সুমাইয়ার মনে হলো - সে চিৎকার করে বলবে - "আপনারা সবাই বাড়ি চলে যান, চাকরিটা আমার ভীষণ দরকার, ভীষণ। আপনারা আমাদের বাঁচার সুযোগ করে দিন প্লিজ, আমি আপনাদের পায়ে ধরছি।" কিছুই বলতে পারলোনা সোমা। মাথার মধ্যে কেমন যেন ঝিমঝিম করছে তার - কেমন যেন শীত শীত লাগছে। জ্বর আসবে নাতো আবার? ভয় পেয়ে গেল সুমাইয়া। বাজার করে তাকে বাসায় ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি - তার বাবা মা আর ফুফু না খেয়ে আছেন সেই দুপুর থেকে। সুমাইয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন বন্ধু ফার্মা এ্যান্ড ফুডস্ এর এমডি তারেক আজিজ। " আপনি না সকালে ফুডস ডিপার্টমেন্টের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন?" " জ্বি স্যার।" " ফার্মাসিটিক্যালে তো ক্লিনারের চাকরি!" " আমি জানি স্যার। আমার একটা চাকরি খুব দরকার - যে কোন কাজ আমি করতে পারবো।" " আমাদের একটা বিষয়ে একটু ভুল হয়েছে। আসলে ডেজিকনেশানটা হবে -'সেনসিটিভ বর্জ্য অপসারণ অপারেটর ', ক্লিনার নয়। এটা খুব সেনসিটিভ একটা কাজ। সেই কারণেই আমরা শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে বি এ পাশ চেয়েছিলাম। কাজটা খুব মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। " আমি পারবো স্যার।" " আঠারো হাজার টাকা বেতনে কাজ করতে পারবেন?" " পারবো স্যার।" " অফিস কিন্তু গাজীপুরে। ঢাকা থেকে অফিস করবেন কিভাবে?" " একটা ব্যবস্থা আমি করে নেবো স্যার।" " ঠিক আছে। আপনি বাসায় চলে যান। আমরা কালকে জয়েনিং লেটার ইস্যু করবো। পরশু হাতে পেয়ে যাবেন। পরশু ছাব্বিশ তারিখ - এক তারিখ থেকে আপনার অফিস।" " অনেক ধন্যবাদ স্যার।" " চাকরি তো পেয়ে গেলেন - এখনও কাঁদছেন কেন?" " জানি না স্যার।" " মনকে শক্ত রাখেন সুমাইয়া। আশাকরি - একটু হলেও আমরা আপনার পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। ভালো ভাবে কাজ করেন। মনে রাখবেন- পরিশ্রমী মানুষের জীবন কখনো এক জায়গায় আটকে থাকে না। আপনি এখন আসেন - দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।" সুমাইয়া রুম থেকে বের হয়ে ফোন করলো ওর মাকে। ফোন রিসিভ করলেন ফুপু। " হ্যালো মা " " সোমা, আমি ফুফু- কাঁদছিস কেন মা, কি হয়েছে?" '" ফুফু - আমার চাকরি হয়েছে।" " আলহামদুলিল্লাহ। এ তো খুশির খবর , খুশির দিনে এভাবে কাঁদছিস কেন ?" " আমি জানিনা ফুফু, মা কই?" " এই যে - নে, কথা বল।" " ভাবী, নাও কথা বলো - সোমার চাকরি হয়েছে।" সুমাইয়ার মা ফোন ধরে কোন কথা বলতে পারলেন না। দু'প্রান্ত থেকে শুধু কান্নার সুর ভেসে এলো দু'জনের কানে। সন্ধ্যা ছয়টা। ইন্টারভ্যু শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। গ্রুপ এমডি তারেক আজিজ রুম থেকে বের হয়ে দেখলেন - বাইরে সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে জল। তিনি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন - " কি ব্যাপার সুমাইয়া, ইন্টারভ্যু তো শেষ হয়েছে অনেক আগে , এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?" " স্যার, আমার কাছে ঢাকায় ফিরে যাবার টাকা নেই।" ",বুঝলাম না। " " আমার এক বন্ধুর বিকাশে কিছু টাকা দেবার কথা ছিলো। দুপুর থেকে তার ফোন বন্ধ।" " আচ্ছা, আপনি আমার সাথে আসেন। আপনার কি শরীর খারাপ?" " মনে হয় জ্বর আসছে।" এমডি স্যার সুমাইয়াকে লিফটে করে ওনার তিন তলার অফিসে নিয়ে গেলেন। অনেক বড় একটা রুম। ওনার টেবিলের সামনে দু'টো চেয়ার। দেয়াল ঘেঁসে তিন প্রান্তজুড়ে মেরুন কালারের সোফা দিয়ে সাজানো। স্যারের চেয়ারের পিছনে বড় একটা পেইন্টিং। গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা ট্রেন লাইন, তারপাশে বড় একটা শিমুল গাছে লাল টকটকে শিমুল ফুল ফুটে আছে। দেখলেই মনে হয় - সবকিছু ভুলে শিমুল গাছটির নীচে গিয়ে বসে থাকি অনন্তকাল। স্যার বললেন - " সুমাইয়া, আপত্তি না থাকলে আপনি আপনার গল্পটা আমাকে বলতে পারেন।" " আমার কোন গল্প নেই স্যার।" " আপনি তো সকালে এসেছেন এখানে, দুপুরে লাঞ্চ করেছেন?" " আমি গতকাল রাত থেকে এখন অব্দি শুধু দুই গ্লাস পানি খেয়েছি।" তারেক আজিজের চোখে হঠাৎ পানি চলে এলো। "আমি একটু আসছি" বলে তিনি দ্রুত ওয়াস রুমে ঢুকে গেলেন। তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে বললেন -" তাহলে আমরা এখন কিছু খেতে পারি - কি বলেন?" সুমাইয়ার শরীর কেমন যেন টলছে। সে বললো - "খাবার পরে এ্যালকোহল খেতে হবে?' " আপনার কথা বুঝলাম না।" " আগে দুটো অফিসে আমাকে খাবারের পরে এ্যালকোহল খেতে হয়েছিলো। তারপর বিছানায়। সেসব জায়গায় আমার চাকরি হয়নি। আমার অবশ্য সয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই আমি এখন তিন মাস পরপর এন্টি প্রেগন্যান্সি ইনজেকশন নিয়ে রাখি। সুমাইয়া কাঁদছে। তারেক আজিজ হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি বলছে এই মেয়েটা! সে কি ঘোরের মধ্যে এসব বলছে, নাকি সত্যি সত্যিই এসব ঘটেছে তার জীবনে? তিনি চেয়ার থেকে উঠে সুমাইয়ার পাশে দাঁড়ালেন। তারপর তার মাথায় একটা হাত রেখে বললেন - " মা রে, আমি তোমার বাবার মতো। একজন বাবার কাছে তার মেয়ের সম্মানের চেয়ে আর কিছু বড় নেই এই পৃথিবীতে। আমার সাথে চারটে ভাত খাও মা। তারপর তোমাকে আমি ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেবো।" তিনি বেল টিপলেন। দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো রুমানা - পরীর মতো সুন্দর একটা মেয়ে। এমন মেয়ের দিকে একবার তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। সে বললো - " " " স্যার, কিছু লাগবে।" " রুমানা, ক্যান্টিনে একটু ফোন করে বলে দাও দুইজনের খাবার রেডি করতে। রেসেপি হলো - সাদা ভাত, পটল দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল আর কাঁঠালের বিচি দিয়ে দেশি মুরগীর মাংস। আধাঘন্টার ভেতরে যেন খাবার রেডি হয়। আর আমাদের আপাতত দুই গ্লাস পানি দাও।" " জ্বি স্যার, এক্ষুনি দিচ্ছি।" রুমানা পানি দিয়ে বাইরে চলে গেলো। তারেক আজিজ বললেন - "মা, পানি খাও। পানি খেয়ে তোমার গল্পটা আমায় বলো। ততক্ষণে খাবার রেডি হয়ে যাবে।" সুমাইয়া ফ্যাল ফ্যাল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। স্যার বললেন - " সুমাইয়া, যে খাবারগুলো অর্ডার দিলাম - এগুলো সব আমার মায়ের পছন্দের খাবার। আমার মা মারা গেছেন অনেক আগে - আমার বয়স তখন মাত্র পনের বছর। আমার মায়ের কথা মনে করেই তাঁর পছন্দের খাবারগুলো তোমার জন্য অর্ডার করলাম। এখনো কি তোমার ভয় লাগছে?" " জ্বি না।" " গুড। এবার বলো - এই পর্যায়ে তুমি পৌছালে কেমন করে?" " অনেক লম্বা গল্প - শুনতে আপনার ভালো লাগবেনা স্যার।" " তুমি বলো - আমি শুনবো।" " কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে - আপনিই বা আমার গল্প শুনতে চান কেন?" " বেশ কিছু কারণ আছে। সেগুলো আজ আর তোমাকে বলবো না। আজ আমি শুধু তোমার কথা শুনবো। তোমার বাবার নাম দেখলাম - ওসমান গনি, মায়ের নাম - মাহমুদা খানম। ঠিকানা লিখেছো - কল্যাণপুর, ঢাকা। তোমার জন্ম কি ঢাকায়?" " জ্বি না স্যার, আমার জন্ম গ্রামে।" " গ্রামের ঠিকানা কি?" " যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার তাহেরপুর গ্রামে আমার জন্ম। আমার বয়স যখন ছয়মাস - তখন আমার বাবা মা আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।" " হঠাৎ ঢাকায় আসার প্রয়োজন পড়লো কেন?" " সে অনেক কথা স্যার।" " তুমি বলো - আমি শুনছি।" " বাবার কাছে শুনেছি - আমার দাদা ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। আমার একমাত্র ফুফুর জন্মের সময় আমার দাদী মারা যান। কিন্তু আমার দাদা আর বিয়ে করেননি। একদিনের মেয়ে আর চার বছরের ছেলেকে আমার দাদা একাই মানুষ করে তোলেন। মনিরামপুর বাজারে আমার দাদার মুদি দোকান ছিলো। ঐ দোকানের ইনকাম দিয়েই সংসার চলতো তাদের । আমার বাবা যখন ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়েন - তখন আমার দাদা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বাবার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল - কারণ বাবাকে তখন দোকান চালাতে হতো। আমার দাদী ছিলেন না বলে আমার ফুফু তেমন কোন কাজ পারতেন না। দাদা অসুস্থ - ফুফুর রান্না কেউ খেতে পারেন না - ফলে দাদা আমার বাবাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এর কিছুদিন পর আমার দাদা মারা যান। দাদা মারা যাবার পরও দোকানের আয় দিয়ে সংসারটা ভালো ভাবেই চলছিলো। হঠাৎ করে সেই দোকানটা বিক্রি করে দিয়ে আমার বাবা তার এক বন্ধুকে কানাডায় পাঠান লেখাপড়া শেখানোর জন্য। আমার আম্মু অনেক নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু বাবা মায়ের কথা শোনেননি। কারণ আমার বাবার কাছে পৃথিবী ছিলো একদিকে 'আর তাঁর বন্ধু ছিলেন অন্যদিকে। অন্য একটা কারণও অবশ্য ছিলো। বাবার সেই বন্ধুটি আমার ফুফুকে খুব পছন্দ করতেন আর ফুফু ছিলেন আমার বাবার জান। বাবা চেয়েছিলেন - তার বন্ধুটি বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে এলে ফুফুর সাথে তার বিয়ে দেবেন। এসমস্ত ঘটনা সব আমার জন্মের বেশ আগে। বাবার সেই বন্ধুটা বিদেশ চলে গেলেন। এর একবছর পর আমার একটা ভাই পৃথিবীতে আসে। আমার ভায়ের জন্মের কিছুদিন পর বাবার সেই বন্ধুটির সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কোন উপায় না পেয়ে বাবা আমার ফুফুকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। আমার ফুফুর যখন বিয়ে হয় - আমার ভাইটার বয়স তখন তিন বছর। বিয়ের এক বছর পর অর্থাৎ আমার ভায়ের যখন চার বছর বয়স তখন আমি আমার মায়ের গর্ভে। আর ঠিক সেই সময় আমার ভাইটির ক্যানসার ধরা পড়ে। আমার বাবা মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বাজারের দোকান বিক্রি করে দেবার পর আমার বাবার আর কোন আয় রোজগার ছিলো না। মাঠে কিছু জমি ছিলো - সেটা বিক্রি করে ফুফুকে বিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে যখন আমার ভায়ের ঐ রোগটা ধরা পড়ে - তখন বাড়ি বিক্রি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না বাবার। বাড়ি বিক্রি করে ভাইটিকে ভারতে নিয়ে যান চিকিৎসা করার জন্য। কিন্তু কোন লাভ হয়না। আমার ভাইটা যেদিন মারা যায় - আমার বয়স তখন মাত্র এক মাস। আমার ভায়ের মৃত্যুর পর আমার বাবা মা অকুল পাথারে পড়ে গেলেন। থাকার জায়গা নেই, আয় রোজগার নেই - খেয়ে না খেয়ে দিন যায়। এই সময় এগিয়ে এলেন আমার ফুফু। আমার ফুফুর নামে বাজারে একটা দোকান ছিলো। ফুফু সেই দোকান বিক্রি করে দিয়ে সব টাকা বাবাকে দিয়ে দেন। সেই টাকার কারণে ফুফুর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর আমার বাবা আমার মা, ফুফু আর আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। " " তারপর" " বাবা ঢাকায় এসে সেই টাকা দিয়ে চারটি সিএনজি কিনে ব্যবসা শুরু করেন। সবকিছু ঠিকঠাক মতো ছিলো। আমার লেখাপড়া, সংসার সবই চলছিলো ঠিকঠাক মতো। সংসারে অভাব কি জিনিস আমি কোনদিন বুঝতে পারিনি। সমস্যা শুরু হলো দুই বছর আগে থেকে। আমি তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। আমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা গেল - বাবার একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, অন্যটার অবস্থাও ভালো না। বাবা বাইরে যেতে পারেননা। কিছুদিন পরপর ডায়ালাইসিস করতে হয়। আমরা ঘোর অন্ধকারে ডুবে গেলাম। গাড়িগুলো একে একে বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা আর সংসার চলতে লাগলো। আমি চাকরির জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করলাম। কিছুই করতে পারলাম না। সংসারে প্রচন্ড অভাব দেখা দিলো। গত তিন মাস ঘর ভাড়া দিতে পারিনি। ধার দেনা করে চলছে বাবার চিকিৎসা আর সংসার। গতকাল বাবার ডায়ালাইসিস করার ডেট ছিলো। টাকার অভাবে করাতে পারিনি। আজ আমি বাজার করে নিয়ে গেলে বাসায় রান্না হবে। এই হলো স্যার আমার গল্প।" খাবার চলে এসেছে। সুমাইয়ার সাথে তারেক আজিজও খেতে বসলেন। শুরু করার আগে তিনি একটা কাগজে কিছু একটা লিখলেন। তারপর সে কাগজটা রুমানার কাছে দিয়ে বিশ মিনিট পরে তিনি জিএম ও ডাইরেক্টরকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। তারেক আজিজ সাহেব টেবিলের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে দু'টি প্লেটে ভাত বেড়ে একটা প্লেট সুমাইয়ার দিকে এগিয়ে দিলেন। সুমাইয়া কিছুই খেতে পারছে না। তার অসুস্থ বাবাকে কতদিন সে ভালোমন্দ খাওয়াতে পারেনি। কাঁঠালের বিচি দিয়ে দেশি মুরগী মাংস তার বাবার ভীষণ পছন্দ। কাঁঠালের সময় এলে বাবা দুইদিন পর পর কাঁঠাল কিনতেন - আর আম্মু সেই কাঁঠালের বিচি ছোট কলসির ভিতরে ছাই দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শীতকাল পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। অথচ গত এক বছরে তাদের বাসায় না হয়েছে কাঁঠাল কেনা, না হয়েছে মুরগী কেনা। আহা, যদি আজ রাতে এই মুরগীর তরকারিটা সে তার বাবাকে খাওয়াতে পারতো!! বাবার সামনে যখন ভাতের সাথে শুধু আলুভর্তা আর ডাল দেওয়া হয় - বাবা তখন শুকনো মুখে মাথা নীচু করে খেয়ে ওঠেন। একটা ডিম পর্যন্ত বাবাকে দিতে পারে না সে। সুমাইয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীতে এতো কষ্ট কেন? কেন ছোট ছোট আশাগুলো এখানে সহজেই মলিন হয়ে যায় অভাব নামক দুর্ভিক্ষে? আজিজ সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি সুমাইয়ার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললেন - " আমার কেন জানি মনে হচ্ছে - কাঁঠালের বিচি দিয়ে দেশি মুরগীর মাংস তোমার বাবার খুব পছন্দ। এজন্য তুমি বাবাকে রেখে খেতে পারছোনা। মানুষের অনুভূতিগুলো আমি খুব সহজেই ধরতে পারি সুমাইয়া। আর সেই কারণেই এই same মেন্যু আমি তোমার বাসার জন্য রেডি করতে বলেছি। তোমার কষ্টটা যদি আমি না-ই বুঝতে পারি - তাহলে তোমাকে 'মা' বলে ডাকার মাঝে আমার তো কোন স্বার্থকতা নেই!!" সুমাইয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওনার দিকে। এই মানুষটা এতো ভালো কেন? উনি কি সত্যি সত্যিই আকাশের মতো একটা মন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন - নাকি এটা স্বপ্নদৃশ্য? এমন মানুষ সত্যিই কি আছে এই স্বার্থের পৃথিবীতে? সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মিটিং শুরু হলো। মোট চার জনের মিটিং। এমডি স্যারের সামনে আরও তিনজন লোক বসে আছেন - ওনাদের কার কি পদবি সুমাইয়ার তা জানা নেই। সুমাইয়া চেয়ার ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসেছে। এমডি স্যার বললেন - " হাবিব সাহেব, আমাদের ফার্মাসিটিক্যালের এজিএম পদটা তো খালি --'' " জ্বি স্যার।" " আমাদের ডিজিএম কতো টাকা স্যালারি ড্র করেন?" " স্যার, এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা।" " আপনি সুমাইয়া নাজনীনের সিবিটা নেন। ওনাকে আমাদের ফার্মাসিটিক্যালের এজিএম পদে নিয়োগ দিয়ে একটা চিঠি ইস্যু করেন - আমি স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। বেতন এক লাখ বিশ হাজার। ওনার বাসা ঢাকার কল্যাণপুরে। যতোদিন উনি গাজীপুরে শিফট না করতে পারবেন, ততোধিক আমাদের একটা গাড়ি উনি ব্যবহার করবেন। আর একটা কথা - আমি কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে সুমাইয়াকে এই পদে নিয়োগ দিচ্ছি। উনি এইসব কাজের কিছুই জানেন না। ছয়মাস আপনারা সবাই ওনাকে কাজ শেখাবেন। ছয়মাস পর আমি ওনাকে এখান থেকে সরিয়ে নেবো। মিটিং শেষ - আপনি দ্রুত জয়েনিং লেটারটা ইস্যু করেন, ততক্ষণে আমি সুমাইয়ার সাথে ছোট্ট একটা মিটিং করবো।" " জ্বি স্যার, আসসালামু আলাইকুম।" " ওয়ালাইকুম আস সালাম।" মিটিং শেষে এমডি স্যার সুমাইয়াকে আবার সামনের চেয়ারে এসে বসতে বললেন। তারপর তিনি বললেন - " " " সুমাইয়া, যেহেতু আমি তোমাকে আমার মেয়ের মতো দেখি সেহেতু আমি তোমাকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করছি। তোমার আপত্তি নেই তো?" " জ্বি না স্যার।" " শোন সুমাইয়া - আমি তোমার গল্পটা শুনলাম, কিন্তু আমার গল্পটা আজ আমি বলতে পারবোনা তোমাকে। আমার নিজের শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই। অল্প কিছু কথা তোমাকে বলবো - খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আমি বুঝতে পারছি - ঘটনার আকস্মিকতায় তুমি বিহ্বল হয়ে পড়েছো। আমি যা করছি, খুবই ঠান্ডা মাথায় হিসাব করেই করছি। আমি চাই - তুমি খুব দ্রুত অফিসের কাজ শিখে নাও। আচ্ছা, তোমার কোন ডাকনাম আছে? সুমাইয়া নামটা অনেক বড় মনে হচ্ছে আমার কাছে।" " জ্বি স্যার, বাসার সবাই আমাকে 'সোমা' বলে ডাকে।" " গুড ৷ শোন সোমা - আগেই বলেছি, তোমাকে আমি মেয়ের মতো দেখি। আমি চাই আমার মেয়েটা করপোরেট জগতে অনেক দুর অব্দি যাক। কোন মানুষ একবারে এতোকিছু পেয়ে গেলে সে নিজেকে অন্য গ্রহের মানুষ মনে করে। এজন্য তোমার সবকিছু আমরা মনিটরিং করবো। কাজের প্রতি অবহেলা, অথবা অন্য কোন ত্রুটি চোখে পড়লে কোম্পানীর স্বার্থে আমরা তোমাকে কাজের থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিবো। এজন্য তোমাকে এবং গার্ডিয়ান হিসাবে তোমার বাবাকে কিছু ডিডে স্বাক্ষর করতে হবে। আর তোমাদের বাড়ির সবার আইডি কার্ডের একটা কপি আমাদের অফিসে জমা রাখতে হবে, তোমার কোন আপত্তি নেই তো?" " জ্বি না স্যার।"