03/17/2025 আশার বাতিঘর হয়ে দেখা দিয়েছে ‘হেঁশেল অর্থনীতি’
আশার বাতিঘর হয়ে দেখা দিয়েছে ‘হেঁশেল অর্থনীতি’
নিজস্ব প্রতিবেদক
৮ আগস্ট ২০২১ ১১:১৪
সমসাময়িক ডেস্ক: করোনাভাইরাসের মধ্যে আর্থিক দুর্দিনে বাড়ির হেঁশেলঘর থেকে পারিবারিক আয়ের উৎস যোগাচ্ছেন নারী। ‘হোমমেড ফুড’ ডেলিভারির বিজনেস নারীদের অর্থ উপার্জনের এই পথ খুলে দিয়েছে। বাড়িররান্না ঘরে তৈরি রকমারি খাবার সরবরাহ করে লাভবান হচ্ছেন তারা। আর খাবার বিক্রির আয় থেকে হচ্ছেন স্বাবলম্বীও। ফলে মহামারী পরিস্থিতির এমন দুঃসময়ে আশার বাতিঘর হয়ে দেখা দিয়েছে ‘হেঁশেল অর্থনীতি’।
দীর্ঘ অচলাবস্থার পর করোনার ধাক্কা সামলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও চলছে অর্থনীতির পুনর্গঠন। আর বাড়ির হেঁশেলঘর কেন্দ্রিক নারীদের এমন ব্যবসায়িক উদ্যোগ মন্দায় পড়া অর্থনীতি পুনর্রুদ্ধারে কিছু মাত্রায় হলেও ভূমিকা রাখবে। এটি ব্যক্তিক-পারিবারিক পর্যায়ের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর মহমারীর ধকল সামলিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে। এছাড়া এরকম কর্ম-উদ্যোগ নারীদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করবে-বলে মনে করেন যশোর সরকারি মহিলা কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার।
তার মতে, অনেকটা অপ্রাতিষ্ঠানিক ধাচের অর্থনীতির এই খাত পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। তিনি জানান, অনলাইন ভিত্তিক নারীদের এই খাবার সরবরাহ ব্যবসা দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন সংযোজন। এটি পরিবারের আয় বৃদ্ধি করছে। আর পারিবারিক আয় বৃদ্ধি মানে সমাজের ও দেশের আয় বৃদ্ধি। সর্বোপরি জাতীয় আয়েরও বৃদ্ধি। জানা গেছে, করোনার মধ্যে অনেকেই হোটেল-রেঁস্তোরায় যাওয়ার বদলে অনলাইনে হোমমেড ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের উপর ঝুঁকে পড়েছেন। আর তার কারণ হলো সংক্রমণের দিনগুলোয় দেশীয় পদের রকমারি খাবার ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। তাছাড়া ঘরোয়া এসব খাবার যেমন মানসম্পন্ন তেমনিভাবে স্বাদেও অনেক ভালো।
আর ক্রেতাদের মতে, বাড়ির তৈরি এসব খাবার হোটেল-রেঁস্তোরার খাবারের চেয়ে অনেক স্বাস্থ্যসম্মতও। এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে সুবিধার দিকটি হলো অনলাইনে অর্ডার করলে চাহিদামাফিক খাবার যথাসময়ে বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে। আর দামও নাগালের মধ্যে হওয়ার ফলে বাসাবাড়ির রান্নাঘরে তৈরি দেশীয় খাবারের কদরও বাড়ছে। জানা যায়, এখান থেকে ৭০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে দুপুর ও রাতের খাবার পাওয়া যায়। এমনকি সাশ্রয়ী দামে মাছ, মাংস, পোলাও-বিরিয়ানিও মেলে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, করোনায় হেঁশেলঘর অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। আর বাড়ির রসুইঘর ঘিরে গড়ে ওঠা এই আর্থিক কারবারে অভিনবত্ব ছাড়াও সৃজনশীল প্রয়াসও আছে। ভাত, মাছ, মাংসের মেন্যু ছাড়াও চটজলতি বানিয়ে ফেলা যায় ‘ভাজাভাজির’ এমনসব রেডিমিক্স আইটেমও তৈরি করছেন নারীরা। আর সর্বোপরি তারা এটিও দেখিয়ে দিলেন যে ‘হেঁশেল ঠেলে’ সেখানেও আর্থিক কারবার গড়ে তোলা যায়।
রসুইঘর ঘিরে ব্যবসা গড়ে তোলা এসব নারী উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাসাবাড়িতে ছোটখাট ডেলিভারির পাশাপাশি মাঝারি গোছের অনুষ্ঠানেও খাবার সরবরাহের ফরমায়েশ পাচ্ছেন। তাদের দাবি, সবার মধ্যে এখন হোমমেড ফুডের কদর বাড়ছে। সবাই চাইছেন বাড়ির রান্না ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত ও ভালো মানের খাবারের স্বাদ পেতে। ফলে অনলাইনভিত্তিক হোমমেড ফুড ডেলিভারির বিজনেস মূল শহর গড়িয়ে মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
করোনার মধ্যে অনলাইনভিত্তিক খাবার সরবরাহ ব্যবসার সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন যশোরের ঝিকরগাছার নারী উদ্যোক্তা সাবিনা হিরা। আলাপচারিতায় জানালেন, ‘হেঁশেলঘরে কিছুক্ষণ’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন। পেজটিতে তার হাতে তৈরি বিভিন্ন খাবারের রেসিপির উল্লেখ করেছেন। আর সেগুলোর অর্ডারের জন্য পেজটিতে মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছেন। যাতে কারোর দরকার পড়লে প্রয়োজন মত অর্ডার দিতে পারেন।
তিনি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু করোনায় দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় বেতনও পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে চাকরি থাকার পরও বেকার হয়ে পড়েছি-বলছিলেন সাবিনা। তাই অনলাইনে খাবার সরবরাহের সাথে যুক্ত হয়েছেন। তার সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল, খাবার নিয়ে রীতিমত উদ্ভাবনী ও সৃজনীর প্রয়োগ করেছেন। চটজলদি ডালের বড়া বানানোর রেসিপি তৈরি করেছেন। যেটি হলো বড়া বানানোর মিক্সড ডালগুঁড়া। পরিমাণমত পানি দিয়ে গুঁড়া ভিজিয়ে নিয়ে পেঁয়াজ দিয়ে মেখে গরম তেলে ছেড়ে দিলেই হয়ে যায় মুচমুচে পেঁয়াজু বা ডালবড়া।
তিনি জানান, এসব ছাড়াও চিনেফ্রাই ও কয়েকরকম রেডি ফ্রোজেজ ফুড আইটেমও তৈরি হয় তার হেঁশেলঘরে। এছাড়াও বাচ্চাদের জন্য পোলাওয়ের চালের সাথে মুগ ও মশুরির ডালের মিশ্রণ। তাতে পরিমাণমত তেল, লবণ, হলুদ ও পানি দিয়ে প্রেসার কুকারে একটা সিটি দিলে কোনো ঝামেলা ছাড়াই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার ও হেলদি খিচুড়ি। যার কোনো জুড়ি নেই। চাইলে তাতে সবজিও দেওয়া যায়।
জানা গেছে, খুব অভিনব না, তবে ইদানিংকালে গড়ে ওঠা অনলাইনভিত্তিক এই ‘হোমমেড ফুড’ সরবরাহের ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। আর যারা এই ব্যবসার হাল ধরে আছে তারা অধিকাংশই নারী। আর তাদের কাছে অর্ডার করলে রুটি, পরোটা, লুচি, ডাল, আলুর দম, শাকভাজি, ছোট মাছ চচ্চরি থেকে আরম্ভ করে মাছ-মাংসের মেন্যুও মিলছে। এছাড়া পোলাও, কোর্মা বিরিয়ানির মত আইটেমের পাশাপাশি ভাতসহ নানা রকমের ভর্তা-ভাজিও পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি মুড়িঘন্ট, কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি, কচুশাকের সাথে ইলিশের মাথা দিয়ে তৈরি নানান দেশি খাবারও।
যশোর শহরের বকচর এলাকার ফারজানা ইয়াসমিন তার ‘বৃষ্টির রান্নার ঘর’ থেকে নানা ধরনের ‘হোমমেড ফুড’ সাপ্লাই করছেন। যার মধ্যে রয়েছে বিফ, চিকেন ও মাটন বিরিয়ানি। মোরগপোলাও, চুঁইঝালের খাসি-মুরগির তরকারির পাশাপাশি আছে নানা রকম রোস্ট আইটেমও।
তিনি জানান, শুধু বাসায় হোমডেলিভারি নয়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের অনুষ্ঠানেও খাবার সরবরাহের অর্ডার পাচ্ছেন। সম্প্রতি যশোর সদর উপজেলা প্রশাসন থেকে চেয়ারম্যানের শূন্যপদে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জন্য খাবার সরবরাহের ফরমায়েশ পেয়েছেন। অর্ডারটিও বেশ বড় অংকের বলে তিনি জানান।