রাহেলা রিকশা থেকে নামলেন, মুখে ভাঁজপড়া একটা মাস্ক। মাস্ক পরে বেশি সময় থাকতে পারেননা তিনি - কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু না পরে উপায় নেই। আরিফ দিনের মধ্যে চৌদ্দবার ফোন করে বলবে -" মা, খবরদার, মাস্ক ছাড়া একদম বাইরে যাবেনা। এই বয়সে করোনার ধকল নিতে পারবেনা তোমরা।"
রাহেলা স্বর্ণের দোকানে ঢুকলেন। তার বিয়ের সর্বশেষ চিহ্ন আংটিটা আজ বিক্রি করতে হবে। আরিফের বাবা এসবের কিছুই জানেনা । বেচারা এম্নিতেই অসুস্হ হয়ে ঘরে পড়ে আছে, এতোসব ধকল নিতে পারবেন না তিনি।
আরিফের বাবা জানেন - আরিফের পাঠানো টাকায় সংসার চলছে। কিন্তু গত এক বছর যাবৎ আরিফ একটা টাকাও পাঠাতে পারেনি, বরং মাঝে মাঝে তাকে কিছু টাকা পাঠাতে হয়েছে। তার টিউশনি বন্ধ। এতোকরে বললাম যশোরে চলে আয় , ছেলে আসবে না। বলে- বাড়ী চলে এলে নাকি চাকরি যোগাড় করতে পারবেনা। ছেলেটা এতো ভালো ছাত্র!! ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাষ্টারস্ করেও টিউশনি করে চলতে হচ্ছে।

অনেক পুরোনো দিনের আংটি। মাত্র দশ হাজার টাকা হাতে পেয়েছেন তিনি। ওর বাবার ঔষধ কিনতেই তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে। বেচারার একটা নতুন পাঞ্জাবি কেনা দরকার। গত ঈদেও কোন নতুন কাপড় কিনে দিতে পারেননি তিনি। অথচ আরিফের বাবা যখন সুস্হ ছিলো - আরিফ আর আমার জন্য কতোকিছুই না কিনে নিয়ে আসতো ঈদের আগে । নতুন কাপড়, মিষ্টি, সেমাই দিয়ে বাড়ীঘর ভর্তি হয়ে যেতো। এক জীবনে এমন দিনও তাকে দেখে যেতে হলো! এই দশ হাজার টাকাই তার শেষ সম্বল। আর আছে তার শ্বশুরের দেওয়া তিন কাঠা জমির উপর একটা পুরাতন একতলা বাড়ী। বাড়ীটা বিক্রি করতে হলে তাদের মাথা গোঁজবার ঠাঁই টুকুও আর থাকবেনা।
রাহেলা দেড় হাজার টাকা খরচ করে একটা পাঞ্জাবি কিনে ফেললেন। ছেলেটা ঈদে বাড়ী আসবে কিনা কিছুই বলছে না। বাড়ী আসলে ওর জন্য একটা মুরগী কিনতে হবে। একটু সেমাই চিনিও কেনা দরকার। গত তিনমাস ধরে রাহেলা নিজের জন্য ঔষধ কিনতে পারছেন না। সেই কারণে পা দু'টো অনেক বেশি ফুলে গেছে তার। বেশি সময় দাড়িয়ে থাকতে পারেননা এখন। রাহেলা পাঞ্জাবির দোকান থেকে বের হয়ে দোকানের বারান্দায় কিছু সময় বসে নিলেন। পা দু'টো ভীষণ টনটন করছে তার।
বাজার করে বাড়ী ফিরলেন রাহেলা। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। বেলা তিনটে বেজে গেছে, আরিফের বাবার গোসল হয়নি এখনও। তিনি স্বামীকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। ইফতারির কোনকিছুই রেডি করা হয়নি। মানুষটা সবজির রোল খেতে অনেক পছন্দ করে। পুরো রোজার মাসে কোনদিন তাকে বানিয়ে খাওয়াতে পারেননি। আজ তিনি রোলের সিট, সবজি - সবই কিনে নিয়ে এসেছেন। এসব করতে গিয়ে প্রায় সব টাকা খরচ হয়ে গেছে তার। মাত্র দুই হাজার টাকা অবশিষ্ট আছে হাতে। ছেলেটা বাড়ী এসে যদি টাকা চায় তাহলে হাত খালি হয়ে যাবে। সামনের মাস কিভাবে চলবে জানি না।
সন্ধ্যার পর রাহেলা পাঞ্জাবিটা তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। অবাক হয়ে আরিফের বাবা বললেন - "তুমি আমার জন্য পাঞ্জাবি কিনেছো কেন? আমি কি ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে যায়? নামাজ তো পড়ি ঘরে।"
রাহেলা বললেন -"তাতে কি? মেয়েরা তো ঈদের মাঠে যায়না। তাই বলে কি নতুন শাড়ী কেনেনা? "
ঃ "তুমি তো নতুন শাড়ী কেননি।"
ঃ "কিনিনি - কারণ আমার অনেক শাড়ী আলমারীতে তোলা আছে।"
ঃ " সেতো আমার জামাও আছে। শোন রাহেলা - তুমি আরিফকে ফোন করে বলে দাও -সে যেন ঈদের পাঞ্জাবি না কেনে। এই পাঞ্জাবিটা আরিফকে দিয়ে দাও। আমার হুইল চেয়ারের চাকা নষ্ট হয়ে গেছে। চাকা চেঞ্জ করা দরকার। "
হঠাৎ রাহেলার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সামনে কি দিন অপেক্ষা করছে জানি না। একটা হুইল চেয়ার কেনা খুব দরকার। ছেলেটার একটা চাকরি হলে আর কোন সমস্যা থাকতো না।
তারাবির নামাজের পর অনেকক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকলেন রাহেলা। দু'চোখ ফেটে কান্না আসছে তার। কি করবেন তিনি, ভয়ানক দুর্দিন অপেক্ষা করছে যে তার জন্য। তিনি জায়নামাজে বসে কাঁদতে কাঁদতেই এক সময় ঘুমিয়ে গেলেন, ঘুম ভাঙ্গলো কলিংবেলের শব্দে।
রাত বারটা বাজে। এতো রাতে কে এলো - খোকা নয় তো? তিনি ছুটে গিয়ে আরিফের বাবাকে জাগালেন। তারপর ছুটে গেলেন দরজার পাশে। ওপাশ থেকে খোকার গলা শোনা যাচ্ছে - " মা দরজা খোল, আমি আরিফ।" রাহেলা দরজা খুললেন, ঐ তো খোকা দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় আট মাস পরে দেখা ছেলের সাথে। খোকার পাশে আর একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। কাকে সাথে করে এনেছে কে জানে?
আরিফ ঘরে ঢুকেই তার বাবার কাছে চলে গেল। বুকটা ভরে গেল রাহেলার। তিনি সংসারের সমস্ত অভাব অভিযোগের কথা ভুলে গেলেন। ছেলের খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে। সাথে অতিথী নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস আজকে বাজার করেছিলেন তিনি।
আরিফ তার মায়ের হাত ধরে বাবার কাছে নিয়ে এলো। বললো- "তোমাদের একটা খুশির খবর দেবো মা। আমার চাকরি হয়েছে। চাকরিটা অবশ্য তিনমাস আগেই হয়েছে। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি। গত তিন মাসের বেতন আমি একসাথে পেয়েছি - একলক্ষ আশি হাজার টাকা। তার থেকে বাবার জন্য পাঞ্জাবি আর একটা নতুন হুইল চেয়ার কিনেছি। তোমার জন্য কিনেছি দুইটা শাড়ী - অনেক দিন তোমার শাড়ী কেনা হয়না। সব বাজার গাড়ীর ভীতরে আছে। সাথে যে ছেলেটা এসেছে, সে আমার ড্রাইভার। অফিস থেকে আমাকে গাড়ী দিয়েছে মা। যেহেতু সে আমাদের এখানে ঈদ করবে - এজন্য তাকেও একটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছি। বাকি আছে আমার কাছে একলক্ষ তেতাল্লিশ হাজার টাকা। তুমি টাকাটা রেখে দাও । আমি চলে যাবার সময় আমাকে শুধু দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলেই চলবে।"
রাহেলার চোখ আবার পানিতে ভরে উঠেছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে, না কি সত্যিই এসব ঘটেছে তার জীবনে? তিনি নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। আরিফকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কান্না শুরু করে দিলেন। আরিফ বললো - " মা, এমন করছো কেন? আমাদের কষ্টের দিন তো শেষ হয়েছে। আজকে মন ভরে একটু হাসতো মা।"
রাহেলা রান্নাঘরে ঢুকলেন। সেহেরির সময় হয়ে যাচ্ছে। ঝটপট দুই একটা পদ রান্না করা দরকার। ঘরে ডিম থাকলে ডিমের কোর্মা করা যেতো - খোকা অনেক পছন্দ করে। রাহেলা ছেলেকে রান্নাঘরে ডাকলেন। বললেন -"খোকা, রান্না হতে সময় লাগবে। তোকে একটু সেমাই রান্না করে দেবো বাবা? " আরিফ হেসে বললো - " এখন সেমাই রান্না করবে কেন মা, আজ কি ঈদ? " তিনি ছেলের কথার উত্তর দিতে পারলেন না। তার চোখ আবার পানিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। তবে সেটা দুঃখের না, আনন্দের।
আজ সত্যিই রাহেলার ঈদ। এমন ঈদের দিন তার জীবনে আগে কখনো আসেনি।