04/20/2025 নতুন একটা কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মাহমুদা রিনি।।
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ২২:২৯
ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। স্বাধীন সত্তায় বাংলাদেশের মানুষের, বাঙালী জাতির বিজয় অর্জনের মাস। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এ মাটি আমাদের অহংকার, দুই লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা এই মাতৃভূমি আমাদের অর্জন। কারো দানে পাওয়া নয়-- এই গৌরব প্রতিটি বাংলাদেশীর অর্জিত অধিকার। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম স্বাক্ষরিত হয়েছিল ষোল ডিসেম্বর। তাই ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের জন্য, বাঙালী জাতির জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
এ মাসেই ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালী জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি এবং শোকাবহ দিন। নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় যখন আমাদের দ্বারপ্রান্তে ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনীর নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার পরিকল্পনায় এদেশের বুদ্ধিজীবী সূর্যসন্তানদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। বিজয় অর্জনের মাত্র দুইদিন আগে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরেই তারা এমন মরণছোবল দেয় বাঙালী জাতির উপর।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ। স্বাধীনতার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং বজ্রকণ্ঠ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদেশের সকল শ্রেণীপেশার মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের মতো জনযুদ্ধ যে শুধু এক ভূখণ্ড দখলের দাবিতে হয়েছিল তাই নয়, সেই সাথে এই ভূখণ্ডে বসবাসরত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বীরবাঙালী সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম নিজেদের একটি দেশের স্বপ্ন মাথায় নিয়ে-- যে দেশটা হবে তাদের নিজেদের! তারা স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারবে। অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হবে। ভাতের অধিকার, শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি মানুষের কথা বলার অধিকার নিশ্চিত হবে। আমরা হয়তো অনেকগুলি মাইল ফলক স্পর্শ করতে পেরেছি! কিন্তু সত্যিকারের স্বাধীনতার সুফল প্রতি ঘরে পৌঁছে দিতে আমাদের এখনো অনেক পথ বাকি। আমরা যারা ধরে নিয়েছি আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা পৌঁছে গিয়েছি। যারা ব্যক্তিস্বার্থের লক্ষ্যে পৌঁছে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবছেন এইতো আমরা সবপেয়েছির দেশ পেয়ে গিয়েছি-- মুক্তিযুদ্ধ নামক জনযুদ্ধটা শুধু তাদের জন্য হয় নাই! সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততায়, তাদের মনোবল আর দৃঢ়তার জয়ই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার জয়। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, দেশটা আমাদের কিন্তু যে সাধারণ মানুষের ভালোবাসার ফসল আজকের বাংলাদেশ তাদের অধিকার এখনো নিশ্চিত হয়নি। একথা স্বীকার করতেই হয় এখনো প্রদীপের নিচে অন্ধকার রয়েই গেছে। এখন হয়তো অস্ত্র নয় কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধটা চলছেই! যদিও জানি এ যুদ্ধের শেষ নেই। আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে! তারপরও বলতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশ একান্ন বছর পার করেছে, সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক। বহুল জনসংখ্যার এই দেশের এখন বালখিল্যতা আর মানায় না। প্রসংগত বলি-- আমাদের সংবিধানে নারীর জন্য সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা সুদূর পরাহত। স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান কোনো অংশেই কম নয়। সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ণারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ নারীরা এখনো হয়রানি সহ নানান রকম নির্যাতনের স্বীকার। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, বাল্যবিবাহ এবং সম্পত্তির সঠিক বন্টন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী সমমর্যাদা পায় না। নারীর মানবাধিকারের যুদ্ধ চলছেই।
মনস্তাত্ত্বিক এই যুদ্ধের দিকে সরকারকে গভীর ভাবে নজর দিতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকলে সেই দেশ সমৃদ্ধ হতে পারে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে একধরণের অব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান হচ্ছে যা আগামীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পেতে যুদ্ধ করে, আবার সেই কৃষিজাত পণ্যই মানুষকে কিনতে হয় সাধ্যাতীত চড়া দামে। মাঝখানে অদৃশ্য বর্গী খেয়ে যায় ধান! চিকিৎসা জীবনের একটি অপরিহার্য বিষয়। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য চিকিৎসা পেতে কী পরিমাণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা কোনো সরকারি হাসপাতালে গেলেই জানা যায়! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! লেখাপড়া শিখে চাকরির জন্য যুদ্ধ, ঘুষ- দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, শ্রমিকের ন্যায়্য মজুরির জন্য যুদ্ধ, সবক্ষেত্রেই এই যুদ্ধ মানুষকে আশাহত করে দেয় যা আগামীর জন্য অশনিসংকেত। অস্বীকার করার উপায় নেই যে দুর্নীতি, অনিয়ম যেভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেধেছে তা বাংলাদেশের অনেক অর্জনকে ভূলুণ্ঠিত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে দুর্নীতি, অনিয়মকে প্রতিরোধ করতে দৃঢ় এবং এক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি এবং সময়ের দাবি। নয়ত লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জাতীয় জীবনের দ্বারপ্রান্তে পৌছবে না।
মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি এবং সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। প্রাণের বিনিময়ে এ অর্জন যেন আমরা সমুন্নত রাখতে পারি। জয় বাংলা, জয় হোক মেহনতি মানুষের।