ছোটগল্প: আমার বাবার বাবার জন্ম হলো পরাধীন ভারতবর্ষে। তখন ভারতবর্ষ ছিলো বৃটিশ বুনিয়াদি শোষণ শাসন। তখন তাঁর জন্ম। তিনি জন্মগ্রহণ করেই চিৎকার করে বলেছিলেন আমি মুক্তি চাই। স্বদেশের উন্মুক্ত আলো বাতাসে বেড়ে উঠতে চাই। মাটির সুধা সুধা গন্ধে প্রাণ জুড়াতে চাই। বেড়ে ওঠার সাথে তাঁর শুরু হয়ে গেলো মুক্তির মিছিল। মুক্তির দাবিতে সেই রাজপথ কাঁপানো মিছিলে বেড়ে উঠা তাঁর দু'চোখ জুড়ে স্বপ্ন নিয়ে। ঠিক তেমনই আমার বাবার ও জন্ম হলো সেই পরাধীন ভারতবর্ষের কোমল মাটির বুকে। আমার বাবাও ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে চিৎকার করে বললেন আমি মুক্তি চাই। আমাকে মুক্তি দাও। আমি স্বাধীন ভারতবর্ষ চাই। ধর্মনিরপেক্ষ অসম্প্রদায়িক ভারতবর্ষ চাই। আমার দাদার মতো আমার বাবাও শুরু করে দিলেন মুক্তির জন্য মিছিল। বাবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা। বাবা জড়িয়ে পড়লেন স্বদেশী আন্দোলনে। একটাই দাবি মুক্তি। স্বদেশ মাকে মুক্ত করতে হবে। ভারতমাতার তেত্রিশ কোটি সন্তান দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। স্বদেশ মাকে এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারলে আমার মুক্তি। স্বদেশী আন্দোলনে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বামী বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বিপ্লবী অরবিন্দ,মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তাঁদের শিয্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। স্বদেশ মাকে মুক্ত করার জন্য প্রথমে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করলেন ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল। জীবন উৎসর্গ করলেন বিনয় বাদল দীনেশ, প্রীতিলতা, ভগৎসিং ,বাঘা যতীন,রাসবিহারী বসু,মাস্টারদা সূর্যসেন,কল্পনা দত্ত, ভারতমাতার লাখো শ্রেষ্ঠ সন্তান।
আমার পূর্ব পুরুষেরা স্বদেশ মাকে মুক্ত করার জন্য ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে সংগ্রাম করে আসছিলেন। রক্ত দিয়ে ছিলেন,জীবন দিয়ে ছিলেন অথচ তাদের মুক্তি আসেনি। নেতাজী আমার বাবার মুক্তির জন্য বলে ছিলেন, "ভিক্ষায় স্বাধীনতা আসে না। আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো"। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমার বাবা উনশো সাতচল্লিশ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন বটে কিন্তু সেটা পরিপূর্ণ মুক্তি নয়। সেই মুক্তি ছিল পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর শৃঙ্খলাবদ্ধ। আবার শুরু হলো শোষণ শাসন আর অত্যাচার। প্রথমেই পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী বাবার মাতৃভাষার উপর আঘাত করলো। বাবা মাতৃভাষার জন্য আটচল্লিশ সালে রাজপথে নামলেন। মাতৃভাষার জন্য জীবন দিলেন রফিক সফিক সালাম বরকত। জীবন দিয়ে , রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাবা ফিরে পেলেন ঠিকই কিন্তু মুক্তি পেলেন না। সেই পাকিস্তানি শোষণ শাসন আর আগ্রাসন। দিন দিন বাড়ছে পশ্চিমাদের অত্যাচারের মাত্রা। দেশে না ছিল কোন গণতন্ত্র আর না ছিল দেশের মানুষের স্বাধীনতা। দেশের মানুষ ছিল বড়ই অসহায়। এক বৃটিশ বুনিয়াদির অত্যাচার শেষ হতে না হতে পশ্চিমাদের অত্যাচার আর শোষণ। তাহলে আমার দাদার মুক্তি কোথায়? কোথায় আমার বাবার মুক্তি? কোথায় আমার মুক্তি? আজ ও আমার মুক্তি হলো না। আমার মুক্তির জন্য অনবরত আমাকে যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ। দেশপ্রেমের জন্য যুদ্ধ। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের জন্য যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করার জন্য যুদ্ধ। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ। এরপর ও আমার যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। যে দিকে তাকাচ্ছি সে দিকেই শুনতে পাচ্ছি অসহায় মানুষের কান্না! খুন ,ধর্ষণ, সুদ, ঘুষ আর দুর্নীতি। তারপর আবার দেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র! তাহলে আমার মুক্তি কোথায়? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর ও কেন আমার মুক্তির জন্য যুদ্ধ আমাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
আমি যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত! হয়তো আমার সন্তানদের যুদ্ধ করতে হবে তাদের মুক্তির জন্য। দেশ স্বাধীন হয়েছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা আর অসম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে। এখন সেই ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য আমাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সংবিধানের সেই চারটি মূলনীতি রক্ষার জন্য আমাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ও আমার দাদা,বাবা যুদ্ধ করেছিল। আমাকেও এখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। হয়তো আমার সন্তানদের সেই যুদ্ধ করতে হবে। তাহলে আমার মুক্তি কোথায়? আর কতকাল আমার মুক্তির জন্য আমাকে যুদ্ধ করতে হবে? আমি আমার মুক্তি চাই। সেই মুক্তি হলো আমার রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সামাজিক, ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসম্প্রদায়িক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা আর আমার মৌলিক অধিকার। যেদিন আমি আমার মৌলিক অধিকার ফিরে পাবো সেই দিন আমার যুদ্ধ শেষ হবে। আর সেই দিন হবে আমার মুক্তি।
ঢাকা-
Email
[email protected]
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২,৩০মাঘ ১৪২৮